১৫. যেমন ছাত্র তেমন শিক্ষক-শেখ সাদির গল্প

পাশ্চাত্য পরিভ্রমণকালে এক মক্তবে একজন শিক্ষক দেখেছিলাম। ওই ধরনের শিক্ষক আমি আর দেখিনি। লোকটা ছিল বেজায় বদমেজাজী, কর্কশভাষী, নির্দয়, অসামাজিক, কঠোর প্রকৃতির একটা ভয়াবহ মূর্তি। তার মুখের দিকে তাকালে মন বিরক্তিতে ভরে ওঠে, আলাপ করার আগ্রহ থাকে না। আর তার কুরআন শরীফ পড়ানো শুনলে মুসলমানের মনেও ভক্তির পরিবর্তে বিতৃষ্ণা জন্মে। একপাল কোমলমতি নিষ্পাপ ছাত্র-ছাত্রী তার নির্মম নির্যাতনের ভয়ে সদা সন্ত্রস্ত্র। কারো দিকে চেয়ে কেউ একটু মুচকি হাসবে বা একটা শব্দ করবে, তার জো নেই। তার মুখে তর্জন-গর্জন লেগেই আছে, আর তার বলিষ্ঠ নির্দয় হাত দুটো কারো কোমল মুখে চড়, কারো পিঠে বেত্রাঘাত অথবা কারো কান ধরে সজোরে মুচড়ে দেয়া প্রভৃতি শাসন কার্যে ব্যস্ত। সারা মক্তব গৃহটা যেন একটা বিভীষিকার কারাগার। এমন দৃশ্য আমার কঠিনমনে বড় বেদনাদায়ক মালুম হলো।

কিছু দিন পর শুনলাম, কি একটা অন্যায় অপরাধে, সেই শিক্ষককে উত্তম মাধ্যম দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তার স্থলে আর একজন ভাল শিক্ষক নিযুক্ত করা হয়েছে। বলাবাহুল্য, শুনে স্বভাবতই ভারী খুশি হলাম। নবাগত শিক্ষকটি ছিলেন পূর্বতন শিক্ষকের সম্পূর্ণ বিপরীত স্বভাবের। ইনি ছিলেন সরল স্বভাব, স্পষ্টভাষী, মধুর ব্যবহার, বিনয়ী ও মিশুক প্রকৃতির। বেহুদা কথা বলেন না কারো মনে ব্যথা পায় এমন কাজও করেন না। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে পুত্রবত স্নেহ করেন।

অল্পদিনের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের মন থেকে শিক্ষক ভীতি উধাও হয়ে গেল। এবং ওস্তাদিনের ফেরশতা স্বাভাবের সুযোগে ছাত্রদের মধ্যে দৈত্যসুলভ স্বভাব দেখা দিতে লাগল। একদল খেলাধুলায় মেতে উঠল আর একদল অপরের মাথায় শ্লেট ভেঙ্গে কুরুক্ষেত্র শুরু করে দিল। ওস্তাদজীর সীমাহীন ধৈর্য থাকার শাসন ক্ষমতা ছিল শিথিল। ফলে শিক্ষার্থীরা নতুন পড়ালেখা তো ছেড়েই দিল। অধিকন্তু পুরনো পড়া যা ছিল, তাও বেমালুম ভূলে গেল। অবশেষে অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়াল যে, বিদ্যালয় আর বিদ্যালয় রইল না। মারামারি ও খেলার আড্ডায় পরিণত হল।

“যে শিক্ষম স্নেহবসে ছাড়িবে শাসন তার হাতে মাটি হবে ছাত্রের জীবন।”

সপ্তাহ দুই পরে আবার সেই পথ দিয়ে যাচ্ছি-দেখি সেই সাবেক শিক্ষক আবার সগৌরবে তার সাবেক আসন দখল করে জেঁকে বসেছেন। তার দুর্দান্ত প্রতাপে মক্তব গৃহ নিরব, নিস্তব্ধ। ভয়ে ভয়ে সবাই নিজ সবক ইয়াদে ব্যস্ত। ক্ষোভ ও বিরক্তিতে মনটা ভরে উঠল। মুখে বললামঃ আবার কেন ইবলিশকে ফেরশতাদের ওস্তাদ বানান হয়েছে। একজন বিজ্ঞ বহুদর্শী বৃদ্ধ আমার কথা শুনে হেসে দিয়ে বললেনঃ মা-বাবার স্নেহ চুম্বনের চেয়ে ওস্তাদের বেত্রাঘাত উত্তম। শোনেন নি?

“এক রাজা দিয়েছিল পুত্রকে স্কুলে

সোনার প্লেট কিনে দিল তার কোলে

সোনার হরফে লেখা ছিল পাশে তার

পিতৃ স্নেহ হতে, ভাল গুরুর অত্যাচার।”

শিক্ষাঃ যেমন ছাত্র তেমন শিক্ষা গুরু না হলে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পায় না। ছাত্র যদি বেয়াদব বা দুষ্টু প্রকৃতির হয় তবে কড়া নজরের শিক্ষক প্রয়োজন। দুষ্টু ছেলেদের গরম মেজাজের শিক্ষক না হলে লেখাপড়া হয় না। ভদ্র, নরম প্রকৃতির ওস্তাদের কাছে দুষ্টু ছেলেদের লেখাপড়া হয় না। তাদের ভদ্রতা ও ধৈর্য্যের কাছে তারা হয়ে উঠে বেয়াদব ও উচ্ছৃঙ্খল।