Learning tips 4

পড়াশুনা জ্ঞানার্জন খুবই গুরুত্বপূর্ন বিষয়, তাই ভাবলাম ছোট ভাই বোনদের এ ব্যাপারে কিছু টিপস দেই। কিভাবে পরীক্ষায় অল্প পরিশ্রমেও পার পেয়ে যাওয়া যায় তা জানা সবার জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ন। পরীক্ষার গোল্লা পেয়ে হাবু ফেরে বাড়ি অভিজ্ঞতা যেন কারো না হয়। বলাই বাহুল্য যে নকলবাজির মত উপকারী বিদ্যা আর কিছু হতে পারে না। নাক বোঁচা জাপানীরা নাকি এত উন্নতি করতে পেরেছে কেবল নকলবাজি করে জ্ঞানী লোকেরা বলেন। ছেলেমেয়েরা যত পরিশ্রম করে গরু ছাগলের মত পড়াশুনা করে তার সামান্য কিছু নকলবাজির কাজে লাগালে কত সহজে ভাল করতে পারে এই সোজা কথাটা অনেকে কেন বুঝতে পারে না ভাবলেই দূঃখ লাগে। সেই দূঃখবোধ থেকেই এ লেখার অবতারনা। আমার এই লেখা একজনেরও পরীক্ষা নামক পুলসেরাত পার হতে সাহায্য করলে এই শ্রম স্বার্থক বলে মনে করব।

 নকল নাম শুনলেই অনেকে নাক কুঁচকাতে পারেন। কাজেই কিছু ব্যাকগ্রাউন্ড তথ্য দেওয়া উচিত। নৈতিকতা ফতা এসব নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। পাশ করার পর সব যে কে সেই। আর নৈতিকতা হল আপেক্ষিক। সকলে মিলিয়া কাজ...সবাই মিলে মিশে শুরু করলে আর নৈতিকতা নামক বেরসিক কোন ব্যক্তি এসে চোখ রাংগাবে না, দেশে ব্যাপক প্রকাশ্য দূর্নীতির ক্ষেত্রে যেই সাইকোলজি কাজ করে তেমন আর কি। নকল প্রবনতা আজকাল অনেক কমেছে, তবে আমাদের আমলে গণ নকল যে কি ব্যাপক মাত্রায় ছিল এখন অনেকেই বললে বিশ্বাস করবেন না। নানান পর্যায়ে কাজটি সূচারুভাবে সমাধা করা হত, কিছু আধা অনৈতিক, কিছু পুরোই বিশুদ্ধ চুরি। আধা অনৈতিকের মধ্যে ধরেন কোন শিক্ষক বোর্ডের প্রশ্ন করেন, খাতা দেখেন তাদের কাছে প্রাইভেট পড়া। আর বিশুদ্ধ চুরি বিদ্যার মধ্যে এরপর বোর্ড অফিসের সক্রিয় সহায়তায় প্রশ্ন ফাঁস করা, পরীক্ষার হলে গণ নকলের মহড়া। পরীক্ষার পরও কার্যক্রম থেমে নেই, আরো ব্যাস্ত সময়। বোর্ড অফিস থেকে বের করা হত কোন পরীক্ষকের কাছে খাতা যাচ্ছে, সে অনুযায়ী পিতা/পুত্র মিলে খাতার পিছু ধাওয়া করে পরীক্ষকের বাসায় মিষ্টির হাঁড়ি এবং মোটা খাম হাতে হাজির হওয়া। আমার এক মামার ৫ সন্তান ছিল পিঠাপিঠি। মামা বেচারাকে প্রতি বছরই অফিস ছুটি নিয়ে এ মিশনে মফস্বল ধাওয়া করতে হত। এতে কোনভাবে ব্যার্থ হলেও চিন্তা নেই। এরপর বোর্ড অফিসে রেজাল্ট আসলে সেখানেও টেবুলেশনে নানান তেলেসমাতি খাটানো; সব মিলিয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থার এক স্বর্ণযুগ গেছে তখন। মনে করার কারন নেই যে এই কাজ অল্প দুয়েকজনে করত। আমার নিজের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজন অনেককেই দেখেছি এসবে যোগ দিতে। খালু সাহেব আদু কন্যাকে পাশ করাতে পাঞ্জাবীর হাতার ভেতর করে নকল নিয়ে সাপ্লাই দিচ্ছেন একটি উদাহরন। বিশেষ করে মফস্বলের দিকে গণ নকলবাজি চলত মোটামুটি উতসব মুখর পরিবেশে। বলাই বাহুল্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষকদের সক্রিয় সহযোগিতায়। আমার এক আত্মীয়কে একবার এক পরীক্ষার গার্ড নকল না আনার অপরাধে বেজায় ধমকে দেন। খুব বিরক্ত কন্ঠে বলেন যে তোদের দোষে তোরা ফেল করবি আর তোদের বাপ মা আমাদের গালি দিবে, আমরা কিছু পড়াই না, অকর্মণ্য এসব বলবে। কি নিদারুন অন্যায়!

  পরীক্ষা কেন্দের ভেতর থেকে বাইরে প্রশ্ন চালান যেত, সেই প্রশ্ন অনুযায়ী বাজার থেকে উত্তরপত্র সাইক্লোষ্টাইল হয়ে আসত, আবার কোন সহৃদয় পরোপকারি হয়ত রীতিমত মাইক ভাড়া করে গাছের ওপর বসে উত্তর পড়ে যাচ্ছেন এমন নজিরও আছে। কেন্দ্রগুলি থেকে প্রতিদিনই বস্তা কে বস্তা নকল উদ্ধার হত। ম্যাজিষ্টেট এলে কিঞ্চিত সমস্যা হত। কেন্দ্রের গার্ড শিক্ষকেরা দ্রুত সবাইকে ইংগিত দিতেন, সাবধান, এসেছে, এসেছে। মাঝে মাঝে বেরসিক কিছু ম্যাজিষ্ট্রেট এসে ঝামেলা করতেন, তবে তারও পালটা ব্যাবস্থা ছিল। ছাত্রদের পাশাপাশি বেশ কিছু পরীক্ষকও বহিষ্কার হত। বাংলার মানুষ চিরকালই আন্দোলন মুখর প্রতিবাদী জাতি। যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো আমাদের মজ্জাগত। নকলের মত মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপই বা কিভাবে মেনে নেওয়া হবে? তাই অনেক যায়গায় প্রকাশ্যেই নকল করতে দেওয়ার দাবীতে মিছিল বের হত। বিরাট রক্তক্ষয়ী সংঘর্য বেধে যেত নকল সরবরাহকারী বনাম থানা পুলিশদের। যাক, সেসব স্বর্নালী দিনের কথা ভাবে হা হুতাশ করে আর কি হবে? এবার আপনাদের এ বিষয়ে আমার কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বলি যা থেকে আশা করি সবাই শিক্ষা গ্রহন করতে পারবেন।

  নিজের ছোটবেলা থেকেই শুরু করি। একদম ছোটবেলায় যাকে বলে লেদু টাইপের ছিলাম। পড়াশুনায় রীতিমত ডাব্বা। বাবা সাংসারিক ব্যাপারে চরম উদাসীন, মা বাড়ির কাজের লোক ড্রাইভার এদের দেখিয়ে আমার ভবিষ্যত ইংগিত করেন, তাতে তেমন লাভ হয় না। কোনমতে পাশ করি, তাও এই বিদ্যা অবলম্বন ছাড়া মনে হয় হত না। তবে তখনো ছোট তো, বুদ্ধি বেশী খেলেনি। পরীক্ষার আগের রাতে পুরো বাসার লোক মিলে হারিকেন হাতে আমার বই খুঁজছে এটা মোটামুটি রুটিন ছিল । অবধারিতভাবে সে বই ফিল্মী কায়দায় খাটের তল থেকে ছিন্নভিন্ন অবস্থায় উদ্ধার হত। (এই অভ্যাস আজো আছে, আমার খাটের তলে আশে পাশে সর্বদাই গোটা দশেক বই থাকে যা প্রতি নিয়ত গৃহ অশান্তির কারন হয়)। পরীক্ষার হলে কাঁপতে কাঁপতে যেতাম। প্রশ্ন দেখলে চোখের পানি বেরিয়ে আসত। কিছুই তো পারি না। বেকুবের মত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রই যত্নের সাথে হুবহু কপি পেষ্ট মেরে আসতাম। এতেই পাশ মিলে যেত। সেসব শিক্ষিকাদের জন্য প্রান খুলে দোয়া করি।

  এরপর আরেকটু বুদ্ধি খোলার পর নানান রকমের বিচিত্র সব কায়দা পর্যবেক্ষন শুরু করি। তবে আমি জড়ভরত ছিলাম দেখে টেবিলের উপর পেন্সিলে লেখা ও ৩০ ডিগ্রী আড়চোখে পাশের জনেরটা মারা ছাড়া আর কোনটাই পারতাম না। অন্য ছেলেরা কি সুন্দর হাঁটুর উপর বই খুলে বা জ্যামিতি বক্সের ভেতর আনা চোথা মেরে লিখত, কেউ আবার অসীম উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও মেধার স্বাক্ষর রেখে স্প্রীং বানাতো। এতে নকল ছোট ছোট কাগজে লিখে সেই কাগজ কেটে কেটে স্প্রীং এর মত পাকানো হত। হাতের তালুতে রেখে তুড়ি মারার মত করে করে পৃষ্ঠা পালটানো হত। এতে হাতের কাজ এবং প্র্যাক্টিস খুব বড় ব্যাপার ছিল, তবে ফল পাওয়া যেত খুবই ভাল। ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা অতি ক্ষীন। মোটা মাথার লোকেরা যদিও বলত যে যে সময় ও শ্রম দিয়ে এটা বানাতে হয় সে সময় পড়াশুনা করলে নাকি এমনিই ভাল করা যায়। এদের কথা আর কি বলব, গাধা কিসিমের লোক সবসময়ই থাকে।

  তবে সতর্কতার কথা সবসময় ফার্ষ্ট প্রায়োরিটি দিতে হবে, এটা ভুলে গেলে কিন্তু মহাবিপদ; তীরে এসে তরী ডুবতে পারে। আমাদের সাথে স্কুলে ফারাবি নামের এক বন্ধু ছিল। তুখোড় ছেলে, বাবা এয়ারফোর্সের গ্রুপ ক্যাপ্টেন, পুরো বাসা কঠোর ধার্মিক, ফারাবি ক্লাস থ্রীতে কোরান খতম দিয়েছে, নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। ধর্ম ও আরব দেশের মহাত্ম্য সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান দেয় (সে আমলে আমাদের নানান কারনে আরব দেশ সম্পর্কে অত্যন্ত উচ্চ ধারনা ছিল)। তবে ধার্মিক হলে হবে কি, বদমায়েশিতেও সে কম যায় না। চোখ দুটি সাক্ষাত শয়তানের মত সারাক্ষন জুলজুল করছে। নকলবাজিতেও তার সফলতা খুবই ভাল। তবে মানুষ মাত্রেই ভুল করে। ক্লাস টেনের প্রি-টেষ্ট পরীক্ষায় অবশেষে ঘটনা ঘটে গেল। জানা গেল ভুগোল পরীক্ষায় ফারাবি ধরে খেয়েছে। ধরা খাবার কারন বিচিত্র। পরীক্ষায় অতিরিক্ত উত্তরপত্র লাগলে তা ষ্টেপল করে মূল কাগজের সাথে লাগাতে হত। সে বেচারা তাড়াহুড়ায় খেয়াল করেনি, অতিরিক্ত কাগজ লাগাবার সাথে সাথে ভুগোল বই এর ছেঁড়া পৃষ্ঠাও ষ্টেপল করে দিয়েছিল। তারপর বিশাল তোলপাড়। নেহায়েত বাবার পরিচয়ে তাকে খুব বড় ধরনের ঝামেলায় পড়তে হয়নি। মেট্রিক পাশ করার পর সে পুরোপুরি তবলিগী হয়ে যায়।

 আমার নিজের নকল জীবন তেমন উজ্জ্বল নয়। তবে একেবারে ফেলনাও নয়। ইন্টারমেডিয়েটে বায়োলজির বিভিন্ন ফুল/প্রানীর শ্রেনী বিন্যাস ছিল রীতিমত আতংকের মত। বর্গ, গোত্র, গণ এসব যতই মুখস্ত করি ততই একটার সাথে আরেকটা গুলিয়ে যেত। তাই পরীক্ষার দিন বাথরুম পদ্ধুতির আশ্রয় নিতে হল। পরীক্ষার মাঝামাঝি বাথরুম গিয়ে একটু জ্ঞানচর্চা আর কি। হায়, সেখানে কি নয়নাভিরাম দৃশ্য। আমার মত জ্ঞান পিপাষুর ভিড়ে রীতিমত বাথরুম প্রকম্পিত। অনেকের এক হাতে সিগারেট, আরে হাতে খোলা বই; গম্ভীর মুখে পায়চারি করে করে রিডিং পড়ছে। আমিও ঝটপট আমার সমস্যা সমাধান করে চলে গেলাম।

 আর ২৫ নম্বরের ব্যাবহারিক পরীক্ষাগুলি ছিল রীতিমত মজাদার। আমার কেমিষ্ট্রী ব্যাবহারিকে সাদা একটি লবন দেওয়া হল পরীক্ষা করে সনাক্ত করতে। কাজটা তেমন সহজ নয়। তবে কোন চিন্তা নেই। কলেজের লতিফ মামু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। টেষ্ট টিউব হাতে নিয়েই....জিংক সালফেট...বিশ টাকা বিশ টাকা। ব্যাস, কিসের আর পরীক্ষা কিসের কি। ২০ টাকা দিয়ে খুশীমনে রিপোর্ট লিখতে বসে গেলাম। এ জাতীয় আরো কত তেলেসমাতি যে ব্যাবহারিকে করা হত বলতে গেলে বিশাল রচনা হবে।

 আগে ধারনা ছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং এসবে ঢুকলে মনে হয় নকলবাজির দিন শেষ। মেডিকেলে ভর্তি হবার পর আবারো আশা ফিরে পেলাম। সিনিয়র ভাইয়েরা আশার আলো দেখান। মেডিকেলের আপারা আমার দেখা সবচেয়ে স্মার্ট মহিলা। ওনারাও অভয় দেন, হাত ব্যাগ খুলে কি আরামে টুকেন সেসব গল্প করেন। এক ল্যাবরেটরির বুড়ো মামুর সাথে আমাদের ভাল ভাব হয়। উনি নানান গল্প করেন আমাদের সাথে। একদিন একজন প্রফেসরের কথা কি কারনে যেন ওঠায় উনি বলে উঠলেন, ওনারে তো ঐ সাবজেক্টে আমিই পাশ করাইছি। বলেন কি! নাতো কি, ৭২ সালে আমি দড়িতে বাইন্ধা নকল সাপ্লাই দিছি, উনি দোতলায় গ্যালারীতে পরীক্ষা দিছেন।

 এরপর বুয়েট আসার পর সে আনন্দ একেবারেই উবে গেল। কি সব পাষান্ডের মত শিক্ষকদের দল। আর কি সতর্কতা। প্রথম ক্লাস টেষ্টের সময় লেকচারার স্যার আমাদের হতচকিত করে ৫ জন সহকারি পাহারাদার নিয়ে আসলেন। বললে কেউ বিশ্বাস করবেন না তাদের হাবভাব পুরোপুরি ইংরেজী ছবিতে দেখানো ট্রেইন্ড কমান্ডোর মত, একেবারে পাথরের মত থমথমে চেহারা। রুমে এসেই মনে হয় পূর্ব পরিকল্পনা মতই কোন কথাবার্তা ছাড়াই এক একজনে এক এক কোনায় চলে গেলেন। দলে একজন মহিলা কমান্ডোও ছিলেন, তবে খুশী হবার কিছু নাই। ওনার চেহারাই ছিল সবচেয়ে কঠোর। ওনাকে ঠিক দেখাচ্ছিল সে সময়কার হিন্দী ছবি গুমরাহ এর এক ভ্যাম্প চরিত্রের মত। মুখের দিকে তাকালেই মুখ আরো শক্ত করে থুতনি ওপরে তুলে করে ভস্ম করে ফেলা চোখে তাকান। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। পরীক্ষকদের চেহারা সূরত হাবভাব দেখে ভয়েই অনেকের পরীক্ষা খারাপ হয়ে গেল।

 তবে দৈত্যকূলে প্রহলাদের মত এদের মাঝেও দুয়েকজন ভাল মানুষ পাওয়া যায়। মডার্ন ফিজিক্স পড়াতেন গিয়াসউদ্দিন স্যার। অতি চমতকার ব্যাবহার, মাটির মানুষ। খুব মজা করে যত্নের সাথে টাইম স্পেস ডায়াগ্রাম, আনিষ্টাইনের তত্ত্ব এসব পড়ান। কিছুই বুঝি না। উনি ২০ নম্বরের ক্লাস টেষ্ট নেবেন। মেধাবী অনেকে খাস নিয়তে উপরে আল্লাহ নীচে বই বলে পেছনের বেঞ্চে গিয়ে বসল। প্রশ্নপত্র এবং উত্তর একই সাথে। সবাইকে বিলি করার পর দেখা গেল যে পেছনের দিকের কয়েকজন প্রশ্নপত্র পায়নি। স্যার এবার সারা জীবন মনে রাখার মত কাজ করলেন। জীভ কেটে বললেন, ভুল হয়ে গেছে, কিছু দেখি শর্ট পড়ল। তবে চিন্তার কোন কারন নেই, তোমরা অপেক্ষা কর। আমি আরো প্রশ্নপত্র নিয়ে আসছি। উনি মনে হয় ভেবেছিলেন উনি আমেরিকা ইংল্যান্ড এমন কোন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন। আমাদের পুরো অরক্ষিত রেখে উনি প্রশ্নপত্র আনতে ডিপার্টমেন্টে চলে গেলেন। আর আমাদের পায় কে? পুরো ক্লাস বলতে গেলে ৭২ সাল। সারা ক্লাসে শুধু খস খস খস খস কাগজ উল্টানোর আওয়াজ। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম নিরীহ কিসিমের দেখতে মেয়েগুলাও কম যায় না। দাঁত কেলিয়ে আরামে টুকে যাচ্ছে। শুধু যারা নকল করবে বলে পেছনের বেঞ্চে বসেছিল ধরা খেয়েছে তারাই। কিছুই করার নেই, চুপ করে দেখছে আমরা কিভাবে ছক্কা পেটাই।

 বুয়েটের পরীক্ষা অত্যন্ত কঠোর হলেও ক্লাস টেষ্টে এ জাতীয় কিছু কিছু কার্যক্রম চালানো যেত। বেঞ্চের উপর বা ফাইলের পিঠে পেন্সিল দিয়ে লেখা মোটামুটি নিরাপদ ছিল। ক্লাস টেষ্টে ধরা পড়লে পরীক্ষায় গোল্লা দেওয়া হত, তবে সাধারনত কোন একাডেমিক ব্যাবস্থা নেওয়া হত না। তাই এইটুকু ঝুকি খুশী মনেও নেওয়া যেত। মাঝে মাঝে ছোট থেকে বড় ধরনের বিপত্তি ঘটে যেত। নুরুদ্দিন নামের একজন খুব ভাল স্যার ছিলেন, সবাইকে আপনি আপনি করে ডাকতেন। যদিও মানুষ খুব ভাল হলেও পড়াতে পারতেন না ভাল। ওনার ক্লাস টেষ্টে কাগজের শিট নিয়ে চুরি করা যেত। ধরা পড়লে তেমন কিছুই করতেন না, কেবল শিটটা নিয়ে নিতেন, এমনকি তারপরেও পরীক্ষা দিতে দিতেন। প্রথম দুয়েকবার ঠেকে শেখার পর ছেলেপিলে একই জিনিস কয়েক কপি করে নিয়ে আসা শুরু করল। স্যার এক কপি নিয়ে যান, আবারো আরেক কপি পকেট থেকে বেরিয়ে যায়। একবার এক ছেলে টেবিলে লিখেছিল। টেবিলে লেখার সমস্যা হল আলো ঠিকমত না পড়লে পড়া যায় না, মাথা একটু ঘুরিয়ে ভিন্ন এংগেল থেকে পড়তে হয়। সে মাথা নানান কায়দায় বেকিয়ে চুরিয়ে টেবিলের লেখা পড়ার চেষ্টা করছিল। স্যারও দেখে ফেললেন। দেখি দেখি, আপনে এমনে এমনে কইরা কি দেখেন! তারপর দেখার পর স্যার পড়ে গেলেন সমস্যায়। কারন ওনার নিয়ম মত সেই বেঞ্চ সিজ করতে হবে। অবশেষে অপরাধীকে অন্য বেঞ্চে সরিয়ে সমস্যার সমাধা হল।

 পাশের জনেরটা কপি করা সবচেয়ে নিরাপদ। তবে স্যারেরা এটা খুব ভাল জানেন দেখে সাধারনত দুই সেট প্রশ্ন বানিয়ে আনতেন যেন পাশাপাশি টুকলিফাই না করা যায়। আবার কেউ কেউ ছিলেন উদা, সাম্যবাদে বিশ্বাসী। এই রকম উদার ছিলেন সোহরাব স্যার। ঘটনার নায়ক মোস্তাফিজ, তার রোল ৯৩। সে টুকবে মনিজ নামের এক গুডি বয়ের খাতা, যার রোল ৭৬। এই মোস্তাফিজ যাকে বলে ফাঁকিবাজের রাজা, চোরের বাসা। সে নিজেও বিশাল দেশী (তাকে এখনো মোটাফিউজ বস্তাফিজ রোলিং বল এইসব স্নেহ করে ডাকা হয়)। বিরাট একটা ডাক্তারি ব্যাগের মত হাত ব্যাগ নিয়ে আসত যা টেবিলের উপর দাঁড় করিয়ে রেখে তার আড়ালে টুকত। এবারও তাই শুরু করল। তবে স্যার একটু পর আঁচ করতে পেলে তাকে বললেন ব্যাগ নামিয়ে রাখতে। সেও ভাল মানুষের মত নামিয়ে রাখল। যদিও তার মত পাকা চোরের কাছে সোহরাব স্যারের মত সিনিয়র স্যারকে গোল দেওয়া বাম হাতের খেল। সে নির্বিঘ্নেই হাসি মুখে কাজ সমাধা করে ফেলল। ঘটনা ঘটল পরে। স্যার পরীক্ষার খাতা জমা গোনার পর থ। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, রোল ৭৬ কে? মনিজ দাঁড়ালো। স্যার বলেন তুমি দুইটা পরীক্ষা দিলে কেমন করে? ঘটনা হল মাছি মারা কেরানির মতই মোস্তাফিজ উতসাহের চোটে নকল মারতে মারতে নিজের রোলের যায়গায় মনিজের রোল পর্যন্ত মেরে দিয়েছে। আসল অপরাধী দাড়ানোর পর স্যার জিজ্ঞাসা করলেন ব্যাপার কি? মোস্তাফিজ আমতা আমতা করে মাথা চুলকাতে চুককাতে বলে, স্যার, আপনি আমাকে ব্যাগটা নামাইতে বলছিলেন যে তখনই আসলে ভুলটা হয়ে গেছে। স্যারও এবার হেসে দিলেন, আমি তোমাকে ব্যাগ নামাতে বললাম আর তাতে তুমি নিজের রোল ভুলে গেলে?

 ক্লাস টেষ্টে একটু ছাড় দিলেও টার্ম ফাইনাল পরীক্ষায় এ জাতীয় কান্ড কীর্তন করে পার পাওয়া মোটামুটি অভাবনীয়। ধরা পড়লে নো মার্সি, এক্কেবারে দেন এন্ড দেয়ার ব্যাক টু দ্যা প্যাভিলিয়ন। ব্যাবস্থা কি রকম কঠোর তার একটি উদাহরন দেই। একবার এক ছেলে বাথরুমে গেল। এক স্যার সন্দেহ হওয়াতে সেই ছেলের পেছু পেছু চুপিসারে বাথরুমে ঢোকেন, সেই গরু টেরও পায়নি। বাথরুমের ভেতর ঢুকলে ভেতরে ছোট ছোট খোপ, যেগুলি পুরো ছাদ পর্যন্ত ছিল না, মাথা হাইট পর্যন্ত। সে এক খোপে ঢুকে দরজা আটকে পকেট থেকে নিশ্চিন্ত মনে চোথা বের করেছে। পঞ্চাশোর্ধ সেই স্যার অসীম বীরত্ব দেখিয়ে দুই হাত সেই খোপের দেওয়ালে কমান্ডো কায়দায় ভর দিয়ে লাফিয়ে উঁচু হয়ে তাকে ধরে ফেলেন। এরপর সেই ছেলেকে ১ বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়।