অত্যাচারিত ও বোকা রাজা- শেখ সাদির গল্প

পারস্য দেশে এক রাজা ছিল। রাজা হলে কি হবে? লোকটা ছিল হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর প্রকৃতির। দয়ামায়া বলতে তাঁর প্রানে কিছুই ছিল না। প্রজাসাধারনের অর্থসম্পদ আত্নসাত করার লোভে তাদের ওপর জোর জুলুম চালাতে তার মোটেই দ্বিধাবোধ হতো না। রাজার হৃদয়হীন ব্যবহারে তার অধিনস্থ কর্মচারীরাও তার ওপর সন্তুষ্ট ছিল না। ক্রমান্বনে অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়াল যে, তার নির্মম অত্যাচারে টিকতে না পেরে অনেক নিরীহ প্রজা তার রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে গিয়ে আশ্রয় নিতে লাগল এবং দিন দিন প্রজার সংখ্যা কমতে শুরু করল। রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ায় রাজকোষ শূন্য হয়ে এলো। দেশের উন্নয়নমূলক কাজ বন্ধ হয়ে গেল। সেনাবাহিনীর জওয়ানেরা যথারীতি বেতন ভাতাদি না পাওয়ায় তাদের মাঝে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠল। এই রাজ্যের প্রতি প্রতিবেশী রাজার লোলুপ দৃষ্টি ছিল। সুযোগ বুঝে তারা আক্রমনের প্রস্তুতি নিয়ে শক্তি সঞ্চয় করতে শুরু করল। দেশ রক্ষার জন্য রাজ কর্মচারী থেকে শুরু করে প্রজাসাধারণ পর্যন্ত কারো ভেতর কোন উতসাহ উদ্দীপনার লক্ষণ দেখা গেল না।

একদা সেই রাজার দরবারে প্রসিদ্ধ শাহানামা কাব্য পড়া হচ্ছিল। বিষয়বস্তু ছিল সম্রাট জোহাকের পতন ও ফেঁরিদুনের অভ্যুত্থান কাহিনী। প্রধানমন্ত্রী বাদশাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ ফেঁরিদূন একজন সাধারণ লোক ছিলেন। তার না ছিল অর্থ সম্পদ, না ছিল সৈন্যসামান্ত। এই অবস্থার ভেতর দিয়ে তিনি জোহাকের মত একজন শক্তিশালী সম্রাটের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে কিভাবে তার সিংহাসন অধিকার করেছিলেন, তা জানেন কি?

বাদশা উত্তরে বললেনঃ শুনেছি দেশের জনগণ তার নেতৃত্বে আস্থাবান হয়ে তার পতাকাতলে সমবেত হয়ে তাঁকে শক্তিশালী করেছিল। তাই তিনি অনায়াসে জয়লাভ করে রাজ্যাধিপতি হতে পেরেছিলেন।

মন্ত্রীমহোদয় বললেনঃ দেশের জনসমর্থনই শক্তির উতস এবং রাজ্য প্রাপ্তির কারণ বলে যদি জানেন, তাহলে জনসাধারনের ওপর জুলুম করে জনমন ক্ষুবধ করেন কেন? আপনার কার্যকলাপে মনে হয় রাজত্ব করার ইচ্ছাই আপনার নেই।

“প্রজাগণ প্রত্রবত কর পালন,

প্রজার শক্তিতে হয় রাজ্য শক্তিমান’।

বাদশা জিজ্ঞেস করলেনঃ জনগন, রাজকর্মচারি ও সেনাবাহিনীর অকুন্ঠ সমর্থন লাভ করার উপায় কি?

মন্ত্রী উত্তর দিলেনঃ রাজা বাদশাহদের দুটো গুণ থাকা অপরিহার্য। একটা হলো, কর্মচারীবৃন্ধ ও প্রজাসাধারণকে পুত্রের মত প্রতিপালন করা এবং অপরটি তাদের জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। দুঃখের বিষয়, এ দুটো গুনের কোনটাই আপনার মধ্যে নেই। আপনার রাজত্ব কি করে রক্ষা পাবে?

হিতাকাঙ্খী মন্ত্রীর উপদেশ ও পরামর্শ বাদশার মনঃপুত হলো না, বরং মন্ত্রীর কথায় অসন্তুষ্ট হয়ে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করলেন।

অল্পদিন যেতে না যেতেই বাদশার চাচাত ভাইয়েরা তার বিরুদ্ধে মাথাচারা দিয়ে উঠল এবং তাদের পৈত্রিক রাজত্ব দাবি করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো। যে সকল প্রজা রাজার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে ছিল, তারা এবং স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনগণ সদলবলে বিপক্ষের সেনাবাহিনীতে যোগ দিল। ফলে অনায়াসে রাজ্য তার হাতছাড়া হয়ে বিপক্ষের অধিকারে চলে গেল।

শিক্ষাঃ রাজ্য শাসন করতে হলে রাজার বহু গুণ থাকা প্রয়োজন। প্রজাসাধারণের মন জয় করে চলতে হবে। তাদেরকে আপনজন মনে করতে হবে। তাদের জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। পক্ষান্তরে রাজা যদি কর্কশ মেজাজের হয়, দেশের সৈন্য সামান্তও প্রজাদের সাথে ভালো ব্যবহার না করে, তবে রাজ্যের ক্ষমতা অল্পের মধ্যেই চলে যাবে।