অস্থিরতায় কাটছে প্রতিটি দিন, প্রতিটি


অস্থিরতায় কাটছে প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ। হিংসা বিদ্বেষ অসত্য আর ধ্বংসের খবরে আকীর্ণ থাকছে দৈনিক পত্রিকা-গণমাধ্যম। অবিবেচনা, অবিবেচক এবং অবিচারের মস্ত এক পাথর যেন বসে আছে সমাজ এবং জাতির মনোজগতে। ইতিহাসে বিভ্রান্তি, ভূগোলে আবিলতা আর ধারাপাতে ছন্দপতনই যেন এখনকার রীতি হয়ে উঠে আসছে। সর্বত্রই বিশ্বাসহীনতা, সমাজ-সংসারকে কুরে কুরে খাচ্ছে। দেশ এবং জাতির হৃদয়ে অশান্তির দাবানল। এই দহন-জ্বালার বিস্তার ঘটছে প্রতিনিয়ত। তামাম বিশ্বজুড়েই যেন এমন দৃশ্য এমন হা হুতাশ। যত ধীরলয়েই হোক নীতি-নৈতিকতা  বর্তমানে নিম্নগামী। নিম্নগামী সভ্যতার পারদ। বিভক্তি এখন সব এলাকায়; কি দেশ কি জাতি, কি সমাজ কি পরিবারে। এই  বিভাজনই অস্থিরতাকে করছে প্রলম্বিত। অবিশ্বাসে আচ্ছন্ন হচ্ছে জাতি-দেশ।  ইদানীং এখান থেকেই বেরিয়ে আসছে বিদ্বেষের ফোয়ারা, ধ্বংসের বিভীষণ। এই বিভীষণরাই মূলত একটি দেশ এবং একটি জাতির আশা-আকাক্সক্ষাকে ছিন্ন-ভিন্ন করার ব্যাপারে যথেষ্ট। এমন উদাহরণ ইতিহাসে অনেক। শংকার সংবাদ হলো এই ভাটিমুলুকেও যেন বিভীষণদের উৎপাত বেড়েই চলেছে। এই বৃদ্ধি এই বিষক্রিয়া জাতি এবং দেশের শিরা-উপশিরাগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে তুলছে দিন দিন। যে জন্য এখন প্রতিটি এলাকায় অশান্তির অনল। বিদ্বেষ বিভেদের বিষবত প্রতিক্রিয়া। সমাজে বাড়ছে হতাশা, হানাহানি, পরিবারে বাড়ছে কলহ- যার তিক্ততায় দেশে বাড়ছে বিসংবাদ-দুর্নীতি-দুর্ভাবনা। কেবল দেশ-জাতি ধ্বংসের অনুষঙ্গই এসব উপলক্ষ নয়, সভ্যতা ধ্বংসের উপাদানও এই লক্ষণগুলো। ইতিহাস এই সত্যগুলোকেই তুলে এনেছে বারবার। এই দেশ এই জাতিও যেন এমনি একটি ক্রান্তিকালে এসে উপনীত হয়েছে।
সময় যাচ্ছে দ্রুত। স্বাধীনতার প্রায় তেতাল্লিশ বছর অতিক্রম করল জাতি। তেতাল্লিশ বছর একটি দীর্ঘ সময়। এই দীর্ঘ সময়েও কলহ মিটল না। অবসান ঘটল না বিভেদ-বিদ্বেষের । শান্তি এখনো সুদূরপরাহত। অশান্তি যেমন আটকে দেয় অর্থনৈতিক উন্নতিকে তেমনি পথ আগলে দাঁড়ায় শিক্ষা-সভ্যতাকেও। শিক্ষা-সভ্যতা থেকেই জন্ম নেয় নীতি-নৈতিকতা। সার্বিক বিবেচনায় এ দিকটির প্রতি দৃষ্টি দিলেও দেখা যাবে শুধু কুয়াশা আর কুয়াশা। জাতি হাবুডাবু খাচ্ছে এমনি এক বিতিকিচ্ছি কুয়াশায়। প্রতিদিনের পত্রিকাগুলোতে থাকছে ধ্বংসের খবর, অশান্তির খবর, বিভেদের খবর। যে সব খবর হিংসা-বিদ্বেষকেই উচকে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিবেক বিবেচনার তোয়াক্কা করছে না কেউ। যে জন্যে স্থিতি আসছে না কোন প্রান্তেই। পৃথিবীতে এমনও দেশ দেখা গেছে স্বাধীনতার দশ-বিশ বছরেই শিরদাড়া শক্ত করে দাঁড়িয়ে গেছে। এর নেপথ্য কারণ বিবেক-বিবেচনা আর দেশপ্রেম। এই প্রেমে ঘাটতি এবং বিবেচনার বৈকল্য তেতাল্লিশ বছরেও কোমরের ব্যাধির উপশম হয়নি। এই ব্যাধি বর্তমানে সর্বাংগে ছড়িয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টিতে পড়ছে ছানি। লেজার অপারেশনেও যেন সারতে চাচ্ছে না। চিরান্ধর দিকে ধাবিত হচ্ছে দেশ-জাতির ভবিতব্য। বসে যাচ্ছে, কল-কারখানা, স্তব্ধ হয়ে পড়েছে নতুন বিনিয়োগ, প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা, শাসনে দক্ষতার অভাব, ভালবাসা মমতায় বৃহ¤œলাসুলভ ব্যবহারেই এমনটা ঘটছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এমনকি অজ্ঞরাও বর্তমানে বুঝতে শুরু করেছে আগামী দিনগুলো অন্ধকার। এই অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে রাজনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষানীতি এমনকি ধর্মনীতিও। ধর্ম মানবজাতিকে সত্যের সন্ধান দেয়, শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করে উন্নতির পথ দেখায়। শোভনকে নিয়ে আসে দৃষ্টির সীমায়। বিশ্বের সব শ্রেষ্ঠ ধর্মগুলোর রীতি-নীতি প্রায় সমপর্যায়ের। মঙ্গল কামনাই ধর্মের বিভূতি। কিন্তু ইদানীং একশ্রেণীর কথিত বিদ্ধজন-চিন্তক ধর্মেও অকল্যাণ ধ্বংস আবিষ্কারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অভিসন্দর্ভ পর্যন্ত রচনা করে ফেলছেন রাতারাতি। আসলে ব্যাপারটি এরকম, ‘চোরায় না শোনে ধর্মের কাহিনী’। হয়তো এই শ্রেণীর বিদ্ধজন-চিন্তকগণ ধর্মের নাম শুনলেই আতঙ্কিত হন। আজকাল শাসন-প্রশাসনে যারা অধিষ্ঠিত হচ্ছেন তারাও কম বেশি বিষয়-ভাবনায় এর বাইরে থাকছেন না। ধর্মের কাহিনী শোনাতে গেলে পদে পদে বাধা। দুর্নীতি-দুঃশাসন অসভ্যতা, অনৈতিকতা এবং অসত্য ধর্মবিবেচনায় পরিত্যাজ্য বিষয়গুলোর মধ্যে প্রধান। এই প্রধানই কারো কারো কাছে মহা অপ্রধান হয়ে উঠে আসছে। যে কারণে এরা ধর্মে এতটা ভয়ে বিবশ। আসলে এই ভয় থেকেই বিদ্বেষের জন্ম। তবে আশার খবর হলো এমন চিন্তক-শাসকের সংখ্যা অতি নগণ্য, সমাজ-সংসারে। এ শ্রেণীটির উৎপাত উৎকণ্ঠিত করে তুললেও তা বরাবরই সাময়িক। অতি ক্ষুদ্র সময়কেই আবেসিত করে, আচ্ছন্ন করে এরা।
বয়সের হিসাবে পৌঢ়ত্বে উপনীত হলেও বুদ্ধি-বিবেচনায় শৈশবের চৌকাঠই যেন অতিক্রম করতে পারেনি এ জাতি। আচার-ব্যবহারে তেমনটাই  প্রকাশমান। যেন ‘ডিমেনশিয়া ব্যাধিতে আক্রান্ত সমগ্র জাতি। কি শিক্ষিত কি অশিক্ষিত, সব একবরাবর। উপশমের কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। দিন দিন আরো প্রকট হচ্ছে এ ব্যাধি। যে কারণে সামাজিক খাতার পৃষ্ঠা যেমন শূন্য, সাহিত্য-সংস্কৃতির জমিনও আগাছায় আকীর্ণ। কেবল সুফলা বুদ্ধি আর বিবেকের বাণিজ্য জমিন। যখন কোন দেশের শিক্ষিতজনরা বিভ্রান্তি ছড়ায় তখন বিভ্রাটে জড়িয়ে যায় জাতি। বাংলাদেশের যা হযবরল অবস্থা তাতে এর বাইরে আর কোন ভাবনার অবকাশ থাকছে না। কি রাজনীতি কি সমাজনীতি সব এলাকার দশাই দিকভ্রান্ত জাহাজের মতো। অনভিজ্ঞ নাবিকই কেবল এ জন্যে দায়ী তাই নয়, নাবিকের অসততাও এ ব্যাপারে প্রকটভাবে উঠে আসে এবং আসছে। কোন কারখানার পরিচালক বা মালিক যদি অসৎ বা দুর্নীতিগ্রস্ত হয় তখন কর্মচারীদের দুর্দশার অবধি থাকে না। পাশাপাশি কর্তা ব্যক্তিটি বা মালিক নির্বোধ হলেও বিপদ অবধারিতভাবে ধেয়ে আসে। তখন ধ্বংস অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। ইদানীং এই দেশ এই সমাজ-কাঠামো উভয়বিদ উপসর্গে আক্রান্ত। কারণ বয়সের তুলনায় বুদ্ধির ঘনত্ব আসেনি। শরীর বৃদ্ধির ব্যাপারটিও তথৈবচ। চিকিৎসা-বিজ্ঞানে যার নামকরণ করা হয়েছে ডিমেনশিয়া। এই ডিমেনশিয়া ব্যাধিতে আক্রান্ত জাতির তাই তেতাল্লিশ বছরেও বালকসুলভ আচরণকে অতিক্রম করতে পারল না।
পত্রিকায় চোখ রাখলেই কেবল ধ্বংসের খবর। হিংসা-বিদ্বেষের শ্রেণীবিন্যাস। পৃষ্ঠাজুড়ে থাকছে অশান্তি আর অসত্যের উগলানো বয়ান। কোথাও আশার বাণী নেই। স্বস্তিদায়ক কোন চিন্তা-ভাবনা যেন ভুলতে বসেছে সবাই। চ্যানেলগুলোতেও দৃশ্যায়িত হচ্ছে জাতিবিধ্বংসী চিত্রাবলি দেশ-বৈরী কথকতা। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। থাকতেও পারে। আছেও, তবে তা খুবই নগণ্য, মাইক্রোস্কোপিক। তাই জাতি ভুগছে আশাহীনতায়, উদ্দেশ্যহীনতায়। শোভন চিন্তায় দেশপ্রেমে নিজেদের যুক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। হিংসা-বিদ্বেষ আর অসত্যের ডামাডোল এতটাই উচ্চনিনাদে বহমান যে, পরিবেশে ভিন্ন কিছু-চিন্তা করার অবকাশই থাকছে না। অপভাবনার নেপথ্যে পড়ে থাকছে শোভন ব্যবহার, চিন্তা-চেতনার ইতিহাস-ভূগোল। সুশীল সমাজের সুভাবনার মাঠটি এখন আগাছায় ভরপুর। এই আগাছা উৎখাতের কোন উদ্যোগ নেই। উৎসাহও যেন ফুরিয়ে গেছে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ক্ষমতাও একপ্রকার নিঃশেষের পথে। যে কারণে সমাজে অসত্য-অশান্তির জয়জয়কার-উল্লাস। নষ্ট সমাজে কষ্ট যেমন বৃদ্ধি পায়, ভ্রষ্টদের উৎপাতও বাড়ে পাল্লা দিয়ে। এই ভ্রষ্টতার বিস্তারে আতঙ্কিত সুনাগরিকগণ-নিরীহ জনতা। যে দেশের সুশাসনের ঘাটতি দেখা দেয় সেই মাটিতেই জন্ম নেয় ভ্রষ্ট চরিত্র, ভ্রষ্ট ধ্যান-ধারণা। এ রকমেরই একটি ভ্রষ্টতায় আটকে গেছে দেশ, জাতির বিবেক-বিবেচনা।
দেশের বিদগ্ধজনরা যখন বিভ্রাটে নিপতিত হয় তখনি আমজনতার অস্থিরতা বাড়ে। মাছের পচন নাকি শুরু হয় মগজ থেকে। এই বঙ্গদেশেও সুশীল আর কুশীল একাকার। উন্মাদের আচরণ প্রতিটি প্রান্তেই। সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনেও বিভাজন, দ্বন্দ্ব, দস্যুতা। সুশীল সমাজও আর সুশীল থাকছে না। দ্বন্দ্ব শেষাবধি মন্দের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তেতাল্লিশ বছরেও তেমন কোনো অর্জন নেই এই অঙ্গনে, কেবলমাত্র হিংসা-বিদ্বেষের কারণে। নিষ্ঠুরতাই এখানে একটি বড় ধরনের উপসর্গ। আর একটি কারণ আপন-ভূমির প্রতি মমতার অভাব। অর্থবিত্তের প্রতি প্রচন্ড রকম লোভ লালসা। অন্যায়-অবিচারে এদের শীতলতা। এ সত্যটিকেই যেন আরো স্পষ্ট করে তুলে আনে। যাদের একমাত্র আরাধ্য হওয়া উচিত সমাজ-সংসারের মঙ্গল কামনা। এরাই যখন বিপরীত চিন্তায় বিভোর হয়, স্বার্থ ভাবনায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকে প্রতিপলে তখনি দেশে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশকেও যেন সে রকমেরই একটি ভয়ানক অমানিশা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। এ থেকে বুঝি উদ্ধারের পথ নেই। হতাশা, শঙ্কা, আশঙ্কাই যেন এ জাতির নিয়তি। বিদগ্ধজনদের ভাবনার জাগরণ এবং সত্যের প্রতি প্রণতিই পরিবেশকে পরিশীলিত করার পথ প্রশস্ত করতে পারে। কিন্তু এমন আশা দূরাশায় পর্যবসিত হচ্ছে। দুর্ভাবনাকেও তুলে আনছে। এরপরও আশার দিকে হস্ত প্রসারিত রাখাটাই সুবিবেচনা। নষ্ট সমাজে বসতি বা নষ্ট শাসনে আক্রান্ত এমনটা ভাবতে কষ্ট হলেও এ রকম ভাবনা থেকে উদ্ধারের উপায় থাকছে না। চারপাশটায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে সেই নষ্টের ভিতরে কষ্টের ঢাক-ঢোল বেজে উঠছে বিকট আওয়াজে। তাই হতাশা আর অস্থিরতা বাড়ছে সমাজে-দেশে। বর্তমান বাংলাদেশের পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে যেন একাকার হয়ে যাচ্ছে হযরত আলী (রা.) একটি বাণী। বাণীটি হলো এ রকম- ‘কখন বুঝবে একটি দেশ ও সমাজ নষ্ট হয়ে গেছে, যখন দেখবে দরিদ্ররা ধৈর্যহারা হয়ে গেছে, ধনীরা কৃপণ হয়ে গেছে, মূর্খরা মঞ্চে বসে আছে, জ্ঞানীরা পালিয়ে যাচ্ছে এবং শাসকরা মিথ্যা কথা বলছে