মনটাকে কাজ দিন 1

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ২৬ সেল নামক ১২ কামরাবিশিষ্ট দীর্ঘ দালানের এক নম্বর কামরায় আমার ১৬ মাসের জেলজীবন কাটাই। দিনের বেলা আমার কামরার সামনে নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে একজন সিপাই সব সময় ডিউটিতে থাকত। সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পালাক্রমে দু’জন সিপাই ৬ ঘন্টা করে অবস্থান করত। রাতেও তাদের প্রত্যেককে ৩ ঘন্টা করে ডিউটি করতে হতো। দীর্ঘ ৬ ঘন্টা সময় তাদের যেভাবে কাটত তা দেখে আমার মায়াই লাগত। কখনো একটু পায়চারি করে, কোনো সময় বারান্দার লোহার সিক ধরে দাঁড়িয়ে, এক সময় দেয়ালে হেলান দিয়ে, মাঝে মাঝে বসে একটু ঝিমিয়ে কোনো রকমে সময়টা পার করতে হতো। ২৬ সেলের চাবির ছড়া হাতে ডিউটিরত অপর একজন সিপাইর সাথে গেটের সিঁড়িতে বসে আলাপ করা কালে তার সময়টা ভালই কাটত বলে মনে হয়। আমি আলাপ করলে সে খুব খুশি হতো। ঐ এলাকার জমাদারকে এ দু’জন সিপাইর সাথে গল্পরত অবস্থায় দেখলে আমি কয়েকজনকে একসাথে পেয়ে জিজ্ঞেস করতাম, আপনারা ডিউটিতে থাকাকালে শরীরটা তো দাঁড়িয়ে, বসে বা হেঁটে সময় কাটায়, কিন্তু মনটা এ সময় কোথায় থাকে এবং কী করে? প্রশ্ন শুনে একে অপরের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে আমার দিকে অসহায় চোখে তাকালে আবার ঐ প্রশ্নই করতাম। তখন একটু ভেবে পাল্টা প্রশ্ন করত, মনে হাজারো চিন্তা ভাবনা তোলপাড় করতে থাকে- পারিবারিক বিষয়, চাকরীতে সমস্যা, অভাব-অনটন নিয়ে দুশ্চিন্তা, আজেবাজে কত কথা যে মনে জাগে, এর কি কোন হিসাব থাকে? আবার প্রশ্ন করতাম, আচ্ছা, এসব ভাবনা-চিন্তা কি নিজে নিজেই এসে ভীড় জমায়, না সচেতনভাবে একটা একটা করে বিষয় নিয়ে ভাবেন? একটু হেসে জবাব দিত, এর কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। কখন যে কোন কথা মনে হাজির হয়ে যায়, তা টেরও পাওয়া যায় না। প্রথমত, এদের কথা বিবেচনা করেই আমার মনে খেয়াল হলো যে, মনটাকে সচেতনভাবে কাজ না দিলে শয়তান সহজেই খালি মনটাকে দখল করে বসে। শুধু পুলিশ, সিপাই, দারোয়ানের বেলায়ই নয় সবার ব্যাপারেই এ কথা সত্য। তাই মনটাকে কাজ দেওয়ার গুরুত্ব অনুভব করে এ পুস্তিকাটি রচনা করা হয়। আমি জেলে থাকাকালেই এ লেখাটি মাসিক পৃথিবীতে প্রকাশিত হয়। এখন তা পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হচ্ছে। আশা করি পাঠক -পাঠিকাগণ এর দ্বারা উপকৃত হবে। আল্লাহ তায়ালা এ লেখাটির উদ্দেশ্য সফল করুন।

গোলাম আযম আগস্ট -১৯৯৩ ইং

আপনার দেহকে শোয়া, বসা, দাঁড়ানো বা হাঁটা-চলা ইত্যাদি যে অবস্থায়ই রাখুন, সর্বাবস্থায়ই আপনার মন কাজ করতে থাকে। এমনকি দেহ যখন ঘুমে অচেতন থাকে তখনো মন কাজ করতে থাকে। এমনকি দেহ যখন ঘুমে অচেতন থাকে তখনো মন কাজ করতে থাকে। কারণ, সে ঘুমায় না। মনোবিজ্ঞানীরা স্বপ্নকে মনের কর্মব্যস্ততা বলে ব্যাখ্যা করেছেন। দেহ যখন ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়ে, মন তখন আরো সক্রিয় হয়। সে ক্লান্ত ও হয় না, বিশ্রামও নেয় না। মনোবিজ্ঞানীরা মনের বিশ্লেষণ এবং চেতন, অবচেতন ও অচেতন মনের ব্যাখ্যা নিয়ে ব্যাপক চর্চা করেছেন। আমার আলোচ্য বিষয় তা নয়। আমরা সবাই এর ভুক্তভোগী যে, আমাদের সজাগ-সচেতন পরিকল্পনা ছাড়াই মনে হাজারো কথা জাগে। সুচিন্তা, কুচিন্তা, দুশ্চিন্তা সব সময়ই মনে ভীড় করেই থাকে। গাড়িতে হোক আর বাড়িতেই হোক, চুপ করে হয়তো বসে আছেন; মন কিন্তু চুপ নয়। কত আজেবাজে, খেইছাড়া, খেইহারা, অগণিত কথা সে বুনেই চলেছে। হাতে কাজ করছেন, আর আপনার বিনা ইচ্ছায় এমনসব কথা মনে জাগছে, যা হয়তো আপনি মন থেকে তাড়াতেই চান। শুদ্ধ উচ্চারণে নামাযে সূরা-কিরআত পড়ছেন, আর মন কোথায় যে ছুটাছুটি করছে তার হিসাব নেই। কোনো কোনো সময় এমন সব খেয়াল মনে জাগে যা বিবেকের নিকট লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়- এ সবই আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা। আমরা যখন মনোযোগ দিয়ে বই পড়ি তখন বই এর আলোচ্য বিষয়ের বাইরের কোন কথা মনে ঢুকবারই ফাঁক পায় না। যখন একাগ্রচিত্তে কারো বক্তৃতা শুনি তখন অন্য কোন ভাব মনে জাগে না। যখন কোন কাজের পরিকল্পনা করতে বসি তখন মনে ভিন্ন চিন্তা স্থান পায় না। কোন বিষয়ে যখন গবেষণায় লিপ্ত হই তখনো বাইরের চিন্তা জাগার সুযোগ পায় না। কোনো বিশেষ ভাব যখন লিখে প্রকাশ করার চেষ্টা করি তখন ভিন্ন ভাব মনে কোনো পাত্তাই পায় না। এ দ্বারা এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, মনকে সচেতনভাবে কোন কাজে ব্যস্ত রাখলে সে অনুগত হয়ে ঐ কাজ করতে থাকে; কিন্তু যখনই তাকে অবকাশ দেওয়া হয় তখনই সে নিজে কাজ যোগাড় করে নেয়। কারণ, সে কখনো অবসর থাকতে পারে না।

বিখ্যাত ইংরেজী প্রবাদ: “Empty mind is devil’s workshop” (শূন্য মন শয়তানের কারখানা) কথাটি বড়ই তিক্ত সত্য। অর্থাৎ মনকে কর্মহীন অবস্থায় রাখা হলে সে খালি থাকবে না। ইবলিশ তাকে কাজ দেবেই। যেহেতু সে বিনা কাজে থাকতে পারে না সেহেতু ইবলিশের দেয়া কাজই সে করতে থাকে। রাসূল (সা.) বলেছেন, মানুষ এমন এক ঘোড়া যার পিঠ কখনো খালি থাকেনা। যদি সে সব সময় আল্লাহকে তার পিঠে সওয়ার করিয়ে রাখে তাহলে সে নিরাপদ। যখনই তার পিঠ খালি হয় তখনই ইবলিশ চেপে বসে। তাই ইবলিশ থেকে বেঁচে থাকতে হলে পিঠ কখনো খালি রাখা চলবে না। সর্বাবস্থায় সচেতনভাবে কথা, কাজ ও চিন্তায় আল্লাহর আনুগত্য করতে থাকলে ইবলিশের আনুগত্য করার সুযোগ পায় না। আমরা যদি আমাদের মনকে শয়তানের কারখানা হওয়ার শোচনীয় পরিণাম থেকে রক্ষা করতে চাই তাহলে মনটাকে হামেশা কাজ দিয়ে ব্যস্ত রাখতে হবে। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, সচেতনভাবে তাকে সব সময় কাজ দিতে থাকব। বিনা কাজে কোন সময়ই তাকে থাকতে দেব না। কথাটা বলা যত সহজ, বাস্তবে করা ততই কঠিন। এর জন্য রীতিমতো অনুশীলন ও অভ্যাস গড়ে তোলা ছাড়া সফলতা সম্ভব নয়। কিন্তু অনুশীলন ও অভ্যাসের জন্য যে নির্দেশনা দরকার তা কোথায় ও কিভাবে পাওয়া যাবে সে প্রশ্নটিই প্রধান। এত বড় একটা বিষয় নিয়ে বহু বছর চিন্তা-ভাবনা করেও কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না। মনকে অনুগত করার চেয়ে কঠিন কাজ আর নেই। যে কাজ দেবো তাই করতে হবে, আর কোন কাজ করতে দেবো না, এমন কর্তৃত্ব মনের উপর হাসিল করা অসাধ্য ব্যাপার। মনকে সব সময়ই ইতিবাচক কাজ দেবার সাধ্য কার?২৪ ঘন্টার জন্য এ বিষয়ে রুটিন তৈরি করে সে অনুযায়ী মনকে পরিচালনা চরম দুঃসাধ্য সাধন বলেই আমার অভিজ্ঞতা।