৭.**বিবাহের প্রয়োজনীয়তা:
মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতে অভ্যস্ত। একাকী বাস তার সবভাব-সিদ্ধ নয়। তাই প্রয়োজন পড়ে সঙ্গিনীর ও কিছু সাথীর; যারা হবে একান্ত আপন। বিবাহ মানুষকে এমন সাথী দান করে। মানুষ সংসারে সবয়ংসম্পূর্ণ নয়। বিবাহ মানুষকে দান করে বহু আত্মীয়-সবজন, বহু সহায় ও সহচর। মানুষের প্রকৃতিতে যে যৌন-ক্ষুধা আছে, তা দূর করার বৈধ ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা হল বিবাহ। বিবাহ মানুষকে সুন্দর চরিত্র দান করে, অবৈধ দৃষ্টি থেকে চক্ষুকে সংযত রাখে, লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করে। বিবাহের মাধ্যমে আবির্ভাব হয় মুসলিম প্রজন্মের। এতে হয় বংশ বৃদ্ধি, রসূল (সাঃ) এর উম্মত বৃদ্ধি। পৃথিবী আবাদ রাখার সঠিক ও সুশৃঙ্খল বৈধ ব্যবস্থা বিবাহ। বিবাহ আনে মনে শান্তি, হৃদয়ে স্থিরতা, চরিত্রে পবিত্রতা, জীবনে পরম সুখ। বংশে আনে আভিজাত্য, অনাবিলতা। নারী-পুরুষকে করে চিরপ্রেমে আবদ্ধ। দান করে এমন সুখময় দাম্পত্য, যাতে থাকে ত্যাগ ও তিতিক্ষা, শ্রদ্ধা, প্রেম, স্নেহ ও উৎসর্গ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴿وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجاً لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآياتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ﴾ অর্থাৎ, তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে আর একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের মধ্য হতেই তোমাদের সঙ্গিনীদেরকে সৃষ্টি করেছেন; যাতে তোমরা ওদের নিকট শান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও স্নেহ সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।[1]
ইসলামে বৈরাগ্যের কোন স্থান নেই। ‘‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়, অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময় লভিব মুক্তির স্বাদ----।’’ এই হল মুসলিমের জীবন। তাই তো বিবাহ করা প্রত্যেক নবীর সুন্নত ও তরীকা। বিবাহ করা এক ইবাদত। স্ত্রী-সঙ্গম করা সদকাহ্তুল্য।[2]
যেহেতু এই পরিণয়ে মুসলিমের বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে নিজেকে ব্যভিচার থেকে রক্ষা করা, স্ত্রীর অধিকার আদায় করা এবং তাকেও ব্যভিচারের হাত হতে রক্ষা করা, নেক সন্তান আশা করা, অবৈধ দৃষ্টি, চিন্তা প্রভৃতি থেকে নিজেকে দূরে রাখা। প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, إذَا تَزَوَّجَ العَبدُ فَقَد استَكمَلَ نِصْفَ الدِّين فَلْيَتَّقِ اللهَ في النِّصف البَاقي. ‘‘(মুসলিম) বান্দা যখন বিবাহ করে, তখন সে তার অর্ধেক ঈমান (দ্বীন) পূর্ণ করে, অতএব বাকী অর্ধেকাংশে সে যেন আল্লাহকে ভয় করে।’’[3] ব্যভিচার থেকে বাঁচার জন্য ও পবিত্র জীবন গঠনের উদ্দেশ্যে বিবাহ করলে দাম্পত্যে আল্লাহর সাহায্য আসে।[4] আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴿وَأَنْكِحُوا الأَيَامَى مِنْكُمْ وَالصَّالِحِينَ مِنْ عِبَادِكُمْ وَإِمَائِكُمْ إِنْ يَكُونُوا فُقَرَاءَ يُغْنِهِمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهِ وَاللهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ﴾ ‘‘তোমাদের মধ্যে যারা অবিবাহিত তাদের বিবাহ সম্পাদন কর এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরও। তারা অভাবগ্রস্ত হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন। আল্লাহ তো প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।[5] জগদ্গুরু মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেন, يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ مَنْ اسْتَطَاعَ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ. ‘‘হে যুবকদল! তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি (বিবাহের অর্থাৎ স্ত্রীর ভরণপোষণ ও রতিক্রিয়ার) সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে। কারণ, বিবাহ চক্ষুকে দস্ত্তরমত সংযত করে এবং লজ্জাস্থান হিফাযত করে। আর যে ব্যক্তি ঐ সামর্থ্য রাখে না, সে যেন রোযা রাখে। কারণ, তা যৌনেন্দ্রিয় দমনকারী।’’[6] তিনি আরো বলেন, النِّكَاحُ من سُنَّتي . فَمَن لَم يَعمَل بسُنَّتي فَلَيسَ مني. ‘‘বিবাহ করা আমার সুন্নত (তরীকা)। সুতরাং যে ব্যক্তি আমার সুন্নত (তরীকা) অনুযায়ী আমল করে না, সে আমার দলভুক্ত নয়।’’[7] সুতরাং বিয়ের বয়স হলে, যৌন-পিপাসায় অতিষ্ঠ হলে এবং নিজের উপর ব্যভিচারের অথবা গুপ্ত অভ্যাসে স্বাস্থ্য ভাঙ্গার আশঙ্কা হলে বিলম্ব না করে যুবকের বিবাহ করা ওয়াজেব। বাড়ির লোকের উচিৎ, এতে তাকে সহায়তা করা এবং ‘ছোট’ বা ‘পড়ছে’ বলে বিবাহে বাধা না দেওয়া। যেমন পূর্বে আরো অবিবাহিত ভাই বা বোন থাকলে এবং তাদের বিয়ের ব্যবস্থা বা ইচ্ছা না হলে এই যুবককে বিবাহে বাধা দেওয়ার অধিকার পিতা-মাতার বা আর কারো নেই। আল্লাহর আনুগত্যে গুরুজনের আনুগত্য ওয়াজেব। যেখানে আল্লাহর অবাধ্যতার ভয় ও আশঙ্কা হবে, সেখানে আর কারো আনুগত্য নেই। বরং এই সব ক্ষেত্রে বিশেষ করে ‘মনমত পণ’ না পাওয়ার জন্য বিয়ে না দিলে মা-বাপের আনুগত্য হারাম। সুতরাং যুবকের উচিৎ, যথাসময়ে বিনা পণে মা-বাপ রাজী না হলেও রাজী করতে চেষ্টা করে বিবাহ করা। নচেৎ তার অভিভাবক আল্লাহ। অনেক সময় দ্বীনদার-পরহেজগার পরিবেশের পুণ্যময়ী সুশীলা তরুণীর সাথে বিবাহে মা-বাপ নিজস্ব কোন স্বার্থে রাজী হয় না। অথবা এমন পাত্রী দিতে চায়; যে দ্বীনদার নয়। দ্বীনদার যুবকের এ ক্ষেত্রেও মা-বাপের কথা না মানা দ্বীনদারী।[8] বৈবাহিক জীবন দু-একদিনের সফর নয়; যাতে দু-একদিন পর সহজভাবে সঙ্গী পরিবর্তন করা যাবে। সুতরাং এখানে ছেলে-মেয়ে সকলেরই বুঝাপড়া ও পছন্দের অধিকার আছে। পক্ষান্তরে দ্বীন ছাড়া অন্য স্বার্থে ছেলে যদি মা-বাপের কথা না মেনে তাদেরকে নারাজ করে বিবাহ করে, তবে এমন ছেলে নিশ্চয়ই অবাধ্য। অবাধ্য মাতা-পিতার এবং অবাধ্য আল্লাহ ও তাঁর রসূলের। এ বিষয়ে আরো কিছু আলোচনা আসবে ‘বিবাহ প্রস্তাব ও তার শর্তাবলী’তে।
ফুটনোটঃ[1] (সূরা আর-রূম (৩০) : ২১)
[2] (মুসলিম ১০০৬নং)
[3] (সহীহ আল-জা-মিউস সাগীর অযিয়াদাতুহ ৬১৪৮নং)
[4] (সহীহ আল-জা-মিউস সাগীর অযিয়াদাতুহ ৩০৫০নং, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩০৮৯নং)
[5] (সূরা আন-নূর (২৪) : ৩২)
[6] (বুখারী, মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩০৮০নং)
[7] (ইবনে মাজাহ ১৮৪৬নং)
[8] (আল-লিকাউশ শাহরী ৩/৪২পৃঃ, ফাতাওয়াল মারআহ ৫৬পৃঃ)
৮.অবৈধ বিবাহ :
বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নারী-পুরুষ বৈধভাবে যৌনসুখ উপভোগ করতে পারে। কিন্তু কোন্ পুরুষ নারীর জন্য বৈধ এবং কোন্ নারী পুরুষের জন্য অবৈধ বা অগম্যা তার বিস্তারিত বিধান রয়েছে ইসলামে।[1] অবৈধ নারীকে অথবা অবৈধ নিয়মে বিবাহ করে সংসার করলে ব্যভিচার করা হয়। এমন কতকগুলি কারণ রয়েছে যার কারণে নারী-পুরুষের আপোসে কোন সময়ে বিবাহ বৈধ নয়।
প্রথম কারণ, রক্তের সম্পর্কঃ
নারী-পুরুষের মাঝে রক্তের সম্পর্ক থাকলে যেহেতু এক অপরের অংশ গণ্য হয় তাই তাদের আপোসে বিবাহ হারাম। এরা হল; ১- পুরুষের পক্ষে; তার মা, দাদী, নানী এবং নারীর পক্ষে; তার বাপ, দাদা ও নানা।
২- পুরুষের পক্ষে; তার কন্যা (বেটী) এবং নাতিন ও পুতিন, আর নারীর পক্ষে; তার পুত্র (ছেলে) এবং নাতি ও পোতা।
৩- পুরুষের পক্ষে; তার (সহোদরা, বৈপিত্রেয়ী ও বৈমাত্রেয়ী) বোন, বুনঝি, ভাইঝি ও তাদের মেয়ে, ভাইপো ও বুনপোর মেয়ে। আর নারীর পক্ষে; তার (সহোদর, বৈপিত্রেয় বা বৈমাত্রেয়) ভাই, ভাইপো, বুনপো ও তাদের ছেলে এবং ভাইঝি ও বুনঝির ছেলে।
৪- পুরুষের পক্ষে; তার ফুফু (বাপের সহোদরা, বৈপিত্রেয়ী বা বৈমাত্রেয়ী বোন) এবং নারীর পক্ষে; তার চাচা (বাপের সহোদর, বৈপিত্রেয় বা বৈমাত্রেয় ভাই)।
৫- পুরুষের পক্ষে; তার খালা (মায়ের সহোদরা, বৈপিত্রেয়ী বা বৈমাত্রেয়ী বোন) এবং নারীর পক্ষে; তার মামা (মায়ের সহোদর, বৈপিত্রেয় বা বৈমাত্রেয় ভাই)।
প্রকাশ যে, সৎ মায়ের বোন (সৎ খালা) পুরুষের জন্য এবং সৎ মায়ের ভাই (সৎ মামা) নারীর জন্য হারাম বা মাহরাম নয়। এদের আপোসে বিবাহ বৈধ।
৬- পুরুষের পক্ষে; তার বাপ-মায়ের খালা বা ফুফু এবং নারীর পক্ষে তার বাপ-মায়ের চাচা বা মামা অবৈধ।[2]
প্রকাশ যে, পুরুষের জন্য তার খালাতো, ফুফাতো, মামাতো, চাচাতো বোন ও (তাদের মেয়ে) বুনঝি বৈধ ও গম্য। অনুরূপ নারীর জন্য তার খালাতো, ফুফাতো, মামাতো, চাচাতো ভাই ও ভাইপো বৈধ ও গম্য। আবার পুরুষের পক্ষে; তার (মামার মৃত্যু বা তালাকের পর) মামী, (চাচার মৃত্যু বা তালাকের পর) চাচী এবং নারীর পক্ষে তার (খালার মৃত্যু বা তালাকের পর) খালু (ফুফুর মৃত্যু বা তালাকের পর) ফোফা গম্য। পূর্বোক্ত গম্য-গম্যার মাঝে বিবাহ বৈধ ও পর্দা ওয়াজেব। রক্তের সম্পর্ক যদি কৃত্রিম হয়, তবে বিবাহ হারাম নয়। সুতরাং (রোগিনীকে রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে তাকে বিবাহ করা রক্তদাতা পুরুষের জন্য অবৈধ নয়। অনুরূপ স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীকে রক্ত দান করলে বিবাহের কোন ক্ষতি হয় না।[3]
দ্বিতীয় কারণঃ বৈবাহিক সম্পর্ক :
১- পুরুষের জন্য (স্ত্রী ও শবশুরের মৃত্যু বা তালাকের পরেও) শাশুড়ী, নানশাশ ও দাদশাশ। (স্ত্রীর সাথে মিলন না হলেও) চিরতরে হারাম। অনুরূপ নারীর পক্ষে তার শবশুর, দাদোশবশুর ও নানাশবশুর অগম্য।
২- রমিতা (যার সাথে সঙ্গম হয়েছে এমন) স্ত্রীর (অপর স্বামীর) কন্যা ও তার বংশজাত কন্যা ও পুতিন বা নাতিন। (স্ত্রীর সাথে মিলন হলে তবে। নচেৎ মিলনের পূর্বে মারা গেলে বা তালাক দিলে তার মেয়ে অবৈধ বা অগম্যা নয়।) তদনুরূপ নারীর জন্য তার স্বামীর (অপর স্ত্রীর) ছেলে ও তার বংশজাত ছেলেও অবৈধ।
৩- পুরুষের জন্য তার সৎমা (বাপ তার সাথে মিলন করুক অথবা না করুক। বাপ মারা গেলে বা তালাক দিলেও) হারাম। অনুরূপ সৎ দাদী এবং নানীও। নারীর জন্য তার সৎবাপ (মায়ের সাথে তার মিলন হলে) অগম্য। অনুরূপ সৎ দাদো এবং নানাও হারাম।
৪- পুরুষের জন্য তার নিজের পুত্রবধূ (আপন ঔরসজাত ছেলের স্ত্রী) অনুরূপ পুতবউ ও নাতবউ এবং নারীর জন্য তার নিজের গর্ভজাত কন্যার স্বামী (জামাই) অনুরূপ নাতজামাই ও পুতজামাই অবৈধ।
সুতরাং পুরুষের জন্য তার সৎশাশুড়ী, স্ত্রীর দুধমা, (বিতর্কিত) এবং পালয়িত্রী মা হারাম নয়। অনুরূপ নারীর জন্য তার সৎশ্বশুর, স্বামীর দুধবাপ (বিতর্কিত) এবং পালয়িতা বাপ অবৈধ নয়। স্বামীর এক স্ত্রীর ছেলে-মেয়ের সাথে দ্বিতীয়া স্ত্রীর পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত ছেলে-মেয়ের বিবাহ বৈধ।[4] প্রকাশ যে, বৈবাহিক সূত্রে মিলনের ফলে যাদের সাথে বিবাহ অবৈধ, ব্যভিচার সূত্রে মিলনের ফলে তাদের সাথে বিবাহ অবৈধ কি না--তা নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। অর্থাৎ যেমন বিবাহের পূর্বে কোন নারীর সাথে ব্যভিচার করলে তার মা বা মেয়েকে বিবাহ করা হারাম হবে কি না এবং বিবাহের পরে ব্যভিচার করলে ঐ নারীর মা বা মেয়ে (যে এই পুরুষের স্ত্রী) তার পক্ষে হারাম হয়ে যাবে কি না, শবশুর-বউ-এ ব্যভিচার করলে ছেলের উপর তার ঐ স্ত্রী হারাম হয়ে যাবে কি না, ব্যভিচারজাত কন্যাকে বিবাহ করা যাবে কি না, -এসব বিষয়ে বড্ড মতভেদ রয়েছে। অবশ্য কোন পক্ষের নিকটেই সহীহ কোন দলীল নেই। যদিও অনুমান, অভিরুচি ও বিবেকমতে হারাম সাব্যস্ত হওয়াই উচিৎ।[5] পরন্তু বহু উলামা বলেন, কারো সাথে ব্যভিচার করলেই সে স্ত্রী এবং তার মা শাশুড়ী হয়ে যায় না। সুতরাং এতে ব্যভিচারের কোন প্রভাব নেই।[6] নৈতিক শৈথিল্যের এমন অশ্লীলতা, পশুত্ব ও সমস্যা থেকে আল্লাহ মুসলিম সমাজকে মুক্ত ও পবিত্র রাখুন। আমীন। পক্ষান্তরে বৈধরূপে স্ত্রী মনে করে সহবাস করলে সম্পর্কে প্রভাব পড়ে। যেমন; বিবাহ-বন্ধন শুদ্ধ না হয়েই সহবাস করলে অথবা সহবাস করার পর জানা গেল যে, ঐ স্ত্রীর সাথে স্বামীও কোন দুধ-মায়ের দুধ পান করেছে। এ ক্ষেত্রে স্ত্রী হারাম সাব্যস্ত হবে এবং তার মা ও মেয়েকে বিবাহ করা ঐ পুরুষের জন্য হারাম হবে।[7]
তৃতীয় কারণঃ দুধের সম্পর্ক :
যদি কোন শিশু (ছেলে অথবা মেয়ে) কোন ভিন্ন মহিলার দুধ পান করে থাকে, তবে সে তার দুধমা। অবশ্য ‘দুধমা’ সাব্যস্তের জন্য কয়েকটি শর্ত রয়েছে; ১। ঐ দুধপান শিশুর ২বছর বয়সের ভিতরে হতে হবে। দু’বছর পার হয়ে দুধপান করলে ‘মা’ সাব্যস্ত হবে না।[8]
২। তৃপ্তিসহকারে পাঁচ অথবা ততোধিক বার দুধপান করবে।[9] স্তনবৃন্ত চুষে অথবা মাইপোষ, চামচ কিংবা নলের সাহায্যে দুধ পেটে গেলে তবেই ‘মা’ সাব্যস্ত হবে।[10] ‘দুধমা’ সাব্যস্ত হলে তার সাথে এবং রক্ত-সম্পর্কীয় অন্যান্য আত্মীয়র ন্যায় ঐ মায়ের বংশের সকলের সাথে বিবাহ অবৈধ হবে।[11]
সুতরাং রীতিমত দুধপানকারী পুরুষ তার দুধ-মা, দুধ-বোন, দুধ-খালা, দুধ-ভাইঝি, দুধ-বোনঝি প্রভৃতিকে চিরদিনের জন্য বিবাহ করতে পারবে না। তদনুরূপ দুধপানকারী মহিলার তার দুধ-বাপ, দুধ-ভাই, দুধ-চাচা, দুধ-মামা, দুধ-ভাইপো, দুধ-বুনপো প্রভৃতির সাথে বিবাহ বৈধ নয়। অবশ্য যে দুধ পান করেছে তার অন্য ভাই-বোনেরা ঐ মায়ের পক্ষে এবং তার ছেলেমেয়ে বা অন্যান্য আত্মীয়র পক্ষে হারাম নয়।[12] কোন পুরুষ যদি (শিশুবেলায়) তার দাদীর দুধ রীতিমত পান করে থাকে, তবে তার পক্ষে রক্ত-সম্পর্কীয় মহিলা ছাড়াও চাচাতো, ফুফাতো এবং নানীর দুধ পান করে থাকলে মামাতো খালাতো বোনও হারাম। কারণ, এই বোনেরা তখন দুধ-ভাইঝি ও দুধ-বোনঝিতে পরিগণিত হয়ে যায়।[13] উল্লেখ্য যে, শৃঙ্গারের সময় স্ত্রীর দুধ মুখে গেলে স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ-বন্ধনে কোন ক্ষতি হয় না। কারণ, এটা রীতিমত দুধ পান নয়।
চতুর্থ কারণঃ লিআন :
স্বামীর সংসারে থেকে যদি স্ত্রী ব্যভিচার ক’রে তা অস্বীকার করে এবং এই ব্যভিচারের উপর যদি স্বামী ৪ জন সাক্ষী কাজীর সামনে উপস্থিত না করতে পারে, তবে কাজী প্রত্যেককে কসম করাবেন; প্রথমে স্বামী বলবে, ‘আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি যে, আমি আমার স্ত্রী অমুককে যে ব্যভিচারের অপবাদ দিয়েছি তাতে সত্যবাদী।’ এইরূপ চারবার বলার পর পঞ্চমবারে তাকে থামিয়ে কাজী বলবেন, ‘আল্লাহকে ভয় কর, এই (শেষ কসম)টাই আল্লাহর আযাব অনিবার্যকারী। (সত্য বল। কারণ,) আখেরাতের আযাব হতে দুনিয়ার আযাব (মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার শাস্তি) সহজতর।’ এরপরেও যদি সে বিরত না হয়, তবে পঞ্চমবারে বলবে, ‘আমি আমার স্ত্রী অমুককে যে ব্যভিচারের অপবাদ দিয়েছি, তাতে যদি আমি মিথ্যাবাদী হই তাহলে আমার উপর আল্লাহর অভিশাপ হোক!’ অতঃপর স্ত্রী অনুরূপ বলবে, ‘আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি যে, আমাকে আমার স্বামী অমুক যে ব্যভিচারের অপবাদ দিয়েছে তাতে ও মিথ্যাবাদী।’ এইরূপ চারবার বলার পর পঞ্চমবারে থামিয়ে কাজী তাকে বলবেন, আল্লাহকে ভয় কর, এটাই আল্লাহর আযাব অনিবার্যকারী, (সত্য বল। কারণ,) আখেরাতের আযাবের চেয়ে দুনিয়ার আযাব (ব্যভিচারের শাস্তি) সহজতর।’ এরপরেও যদি বিরত না হয়, তাহলে পঞ্চমবারে সে বলবে, ‘আমাকে আমার স্বামী অমুক যে ব্যভিচারের অপবাদ দিয়েছে, তাতে যদি ও সত্যবাদী হয়, তাহলে আমার উপর আল্লাহর গযব হোক!’ এতদূর করার পর কাজী স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ করে দেবেন। আর এতে কারো শাস্তি হবে না।[14] এই ধরনের লা’নত ও অভিশাপের বিচ্ছেদকে ‘লিআন’ বলে। এই বিচ্ছেদ হওয়ার পর ঐ স্ত্রী ঐ স্বামীর জন্য চিরতরে হারাম হয়ে যায়। কোন প্রকারে আর পুনর্বিবাহ বৈধ নয়।[15] প্রকাশ যে, রক্ত, দুধ ও বৈবাহিক সম্পর্কের ফলে যাদের আপোসে চিরতরে বিবাহ অবৈধ কেবল তাদের সামনেই মহিলার পর্দা নেই। বাকী বন্ধুত্ব, পাতানো, বা পীর ধরার (?) ফলে কেউ হারাম হয় না। সুতরাং বন্ধুর বোন, পাতানো বোন এবং পীর-বোনের (?) সাথেও বিবাহ হালাল এবং পর্দা ওয়াজেব। আরো এমন কতকগুলি কারণ রয়েছে যাতে নারী-পুরুষের বিবাহ চিরতরে হারাম নয়; তবে সাময়িকভাবে হারাম। সেই নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হলে বিবাহ বৈধ। এমন কারণও কয়েকটিঃ-
প্রথম কারণঃ কুফর ও শির্ক।
কোন মুসলিম (নারী-পুরুষ) কোন কাফের বা মুশরিক (নারী-পুরুষ)কে বিবাহ করতে পারে না। অবশ্য ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হলে তার সাথে বিবাহ বৈধ। এ ব্যপারে মহান আল্লাহ বলেন, ﴿وَلاَ تَنْكِحُوا الْمُشْرِكَاتِ حَتَّى يُؤْمِنَّ وَلَأَمَةٌ مُؤْمِنَةٌ خَيْرٌ مِنْ مُشْرِكَةٍ وَلَوْ أَعْجَبَتْكُمْ وَلاَ تُنْكِحُوا الْمُشْرِكِينَ حَتَّى يُؤْمِنُوا وَلَعَبْدٌ مُؤْمِنٌ خَيْرٌ مِنْ مُشْرِكٍ وَلَوْ أَعْجَبَكُمْ أُولَئِكَ يَدْعُونَ إِلَى النَّارِ وَاللهُ يَدْعُو إِلَى الْجَنَّةِ وَالْمَغْفِرَةِ﴾ ‘‘আর অংশীবাদী রমণী যে পর্যন্ত মুসলমান না হয়, তোমরা তাকে বিবাহ করো না। মুশরিক নারী তোমাদের পছন্দ হলেও নিশ্চয়ই মুসলিম ক্রীতদাসী তার চেয়ে উত্তম। আর মুসলমান না হওয়া পর্যন্ত অংশীবাদী পুরুষের সাথে কন্যার বিবাহ দিও না। অংশীবাদী পুরুষ তোমাদের পছন্দ হলেও মুসলিম ক্রীতদাস তার চেয়ে উত্তম। কারণ, ওরা তোমাদেরকে জাহান্নামের দিকে আহবান করে এবং আল্লাহ তোমাদেরকে নিজ অনুগ্রহ ও ক্ষমার দিকে আহবান করেন।’’[16] {لَا هُنَّ حِلٌّ لَّهُمْ وَلَا هُمْ يَحِلُّونَ لَهُنَّ} (10) سورة الممتحنة ‘‘মু’মিন নারীগণ কাফের পুরুষদের জন্য এবং কাফের পুরুষরা মু’মিন নারীদের জন্য বৈধ নয়।’’[17] শিয়া, কাদেয়ানী, কবুরী, মাযারী এবং মতান্তরে বেনামাযী প্রভৃতি পাত্র-পাত্রীর সাথে কোন (তওহীদবাদী) মুসলিম পাত্র-পাত্রীর বিবাহ বৈধ নয়।[18] পক্ষান্তরে আসমানী কিতাবধারী ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টান সচ্চরিত্র নারীকে (ইসলাম গ্রহণ না করলেও) মুসলিম পুরুষ বিবাহ করতে পারে।[19] তবে এর চেয়ে মুসলিম নারীই যে উত্তম তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কোন মুসলিম নারীর সাথে কোন কিতাবধারী পুরুষের বিবাহ বৈধ নয়; যতক্ষণ না সে ইসলাম গ্রহণ করেছে। যেহেতু ইসলাম চির উন্নত, অবনত হয় না। তাছাড়া মুসলিমরা সকল নবীর প্রতি ঈমান রাখে, কিন্তু কিতাবধারীরা ইসলামের সর্বশেষ নবী (সাঃ)-এর প্রতি ঈমান রাখে না।[20] প্রকাশ যে, মুসলিম নামধারী মুশরিকরা (যারা আল্লাহ ছাড়া পীর, কবর বা মাযারের নিকট প্রয়োজনাদি ভিক্ষা করে, তারা) আহলে কিতাবের মত নয়। তাদের সাথে বিবাহ-শাদী বৈধ নয়।[21] কোন পুরুষ ইসলাম গ্রহণ করলেও চট্ করে তার সাথে মুসলিম নারীর বিবাহ দেওয়া উচিৎ নয়। মুসলিম হয়ে নামায-রোযা ও অন্যান্য ধর্মীয় বিষয় পালন করছে কি না, তা দেখা উচিৎ। নচেৎ এমনও হতে পারে (বরং অধিকাংশ এমনটাই হয়) যে, মুসলিম যুবতীর রূপ ও প্রেমে মুগ্ধ হয়ে কেবল তাকেই পাবার উদ্দেশ্যে নামে মাত্র মুসলিম হয়ে ইসলামে ফাঁকি দেয়।[22] কোন মুসলিম পুরুষ অমুসলিম নারীকে বিবাহ করতে চাইলে তাকে প্রকৃত মুসলিম করে ইদ্দত দেখে তারপর বিবাহ করবে। নামায-রোযা প্রভৃতিতে যত্নবান না হলে বিবাহ বৈধ হবে না।[23]
দ্বিতীয় কারণঃ- অপরের স্বামীত্বঃ
অপরের বিবাহিতা স্ত্রী তার স্বামীত্বে থাকতে আর অন্য পুরুষের জন্য বৈধ নয়। সে মারা গিয়ে অথবা তালাক দিয়ে ইদ্দতের যথা সময় অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত ঐ রমণীকে বিবাহ করা হারাম। সুতরাং ঐ মহিলা আসলে গম্যা, কিন্তু অপরের স্বামীত্বে থাকার জন্য সাময়িকভাবে অন্যের পক্ষে অবৈধ। এমন বিবাহিত সধবাকে কেউ বিয়ে করলেও বিবাহ-বন্ধনই হয় না। সে প্রথম স্বামীরই অধিকারভুক্ত থাকে, আর দ্বিতীয় স্বামী ব্যভিচারী হয়। পরন্তু একটি মহিলা একাধিক স্বামী গ্রহণ করতে পারে না। কারণ এতে বংশ ও সন্তানের অবস্থা সর্বহারা হয়। পক্ষান্তরে একজন পুরুষ একাধিক স্ত্রী (৪টি পর্যন্ত) গ্রহণ করতে পারে।[24] কারণ, এতে ঐ ভয় থাকে না। তাছাড়া বলাই বাহুল্য যে, ইসলাম মানবপ্রকৃতির জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ ধর্ম। জীবনের সর্বপ্রকার সমস্যার সমাধান খুঁজে মিলে এই ধর্মে। মানবকূলের সকল মানুষের প্রকৃতি, যৌনক্ষুধা বা কামশক্তি সমান নয়। স্ত্রী তার বীর্যবান স্বামীর সম্পূর্ণ ক্ষুধা নাও মিটাতে পারে; বিশেষ করে যদি সে রোগা হয় অথবা তার ঋতুর সময় দীর্ঘস্থায়ী হয়। পক্ষান্তরে ব্যভিচারও মানবচরিত্রের প্রতিকূল। স্ত্রী বন্ধ্যা হলে বংশে বাতি দেবার জন্য সন্তান লাভের উদ্দেশ্যে অথবা একজন বিধবা বা পরিত্যক্তার সৌভাগ্য ফিরিয়ে আনতে এবং আরো অন্যান্য যুক্তিযুক্ত কারণে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বিবাহ সংসারে প্রয়োজন হয়। আর এটা নৈতিকতার পরিপন্থী নয়। চরিত্র ও নৈতিকতার প্রতিকূল তো এক বা একাধিক উপপত্নী বা ‘গার্ল্স ফ্রেন্ড্’ গ্রহণ করা।[25]
শর্ত আছেঃ :
৯.পক্ষান্তরে একাধিক বিবাহের শর্ত আছেঃ :
১- একই সঙ্গে যেন চারের অধিক না হয়।
২- স্ত্রীদের মাঝে যেন ন্যায়পরায়ণতা থাকে। ভরণ-পোষণ, চরিত্র-ব্যবহার প্রভৃতিতে যেন সকলকে সমান চোখে দেখা হয়। সকলের নিকট যেন সমানভাবে রাত্রি-বাস বা অবস্থান করা হয়। নচেৎ একাধিক বিবাহ হারাম।[26] অবশ্য অন্তরের গুপ্ত প্রেমকে সকলের জন্য সমানভাবে ভাগ করা অসম্ভব।[27]
তাই অন্তর যদি কাউকে অধিক পেতে চায় বা ভালোবাসে তবে তা দূষণীয় নয়। কিন্তু প্রকাশ্যে সকলের সাথে সমান ব্যবহার প্রদর্শন ওয়াজেব। একাধিক বিবাহ করলে কোন স্ত্রীর মন্দ-চর্চা অন্য স্ত্রীর নিকট করবে না। কোন স্ত্রীকে অন্য স্ত্রী প্রসঙ্গে কুমন্তব্য বা কুৎসা করতে সুযোগ দেবে না। তাদের আপোষে যাতে ঈর্ষাঘটিত কোন মনোমালিন্য বা দুর্ব্যবহার না হয়, তার খেয়াল রাখবে। পৃথক-পৃথক বাসা হলেই শান্তির আশা করা যায়। নচেৎ ‘নিম তেঁতো, নিষিন্দি তেঁতো, তেঁতো মাকাল ফল, তাহারও অধিক তেঁতো দু’ সতীনের ঘর।’ বিশেষ করে বেপর্দা পরিবেশ হলে তো তিক্তময় নরক সে সংসার। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, দ্বিতীয় বিবাহ করার সময় প্রথম স্ত্রীর অনুমতি জরুরী নয়।[28] কুফরীর কারণে স্বামীর অধিকার থেকে ছিন্ন হয়ে মুসলিমদের যুদ্ধবন্দিনীরূপে কোন মুজাহিদের ভাগে এলে এক মাসিক পরীক্ষার পর অথবা গর্ভ হলে প্রসব ও নেফাসকাল পর্যন্ত অপেক্ষার পর অধিকারভুক্ত হবে; যদিও তার স্বামী বর্তমানে জীবিত আছে।[29] কোন মহিলার স্বামী মারা গেলে অথবা তালাক দিলে সে তার ইদ্দতকাল পর্যন্ত ঐ স্বামীর অধিকারে থাকে। অতএব কোন রমণীকে তার ইদ্দতকালে বিবাহ করা অবৈধ।[30] ইদ্দতের বিস্তারিত বিবরণ পরে আসবে ইনশাআল্লাহ। কোন মহিলা গর্ভবতী থাকলে গর্ভকাল তার ইদ্দত। গর্ভাবস্থায় বিবাহ বৈধ নয়। অবৈধ গোপন প্রেমে যার ব্যভিচারে গর্ভবতী হয়েছে সেই প্রেমিক বিবাহ করলেও গর্ভাবস্থায় আক্দ সহীহ নয়। প্রসবের পরই আক্দ সম্ভব।[31] কোন মহিলার স্বামী নিখোঁজ হলে নিখোঁজ হওয়ার দিন থেকে পূর্ণ চার বছর অপেক্ষা করার পর আরো চার মাস দশদিন স্বামী-মৃত্যুর ইদ্দত পালন করে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করতে পারে। এই নির্ধারিত সময়ের পূর্বে তার বিবাহ হারাম। বিবাহের পর তার পূর্ব স্বামী ফিরে এলে তার এখতিয়ার হবে; স্ত্রী ফেরৎ নিতে পারে অথবা মোহর ফেরৎ নিয়ে তাকে ঐ স্বামীর জন্য ত্যাগ করতেও পারে।[32] স্ত্রী চাইলে আর নতুনভাবে বিবাহ আক্দের প্রয়োজন নেই। কারণ, স্ত্রী তারই এবং দ্বিতীয় আক্দ তার ফিরে আসার পর বাতিল। তবে তাকে ফিরে নেওয়ার পূর্বে ঐ স্ত্রী (এক মাসিক) ইদ্দত পালন করবে।[33] গর্ভবতী হলে প্রসবকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। আর সে সময়ে দ্বিতীয় স্বামী থেকে পর্দা ওয়াজেব হয়ে যাবে। তৃতীয় কারণঃ- দুই নিকটাত্মীয়র জমায়েত সাধারণতঃ একাধিক বিবাহে অশান্তি বেশীই হয়। সতীন তার সতীনকে সহজে সইতে পারে না। সতীনে-সতীনে বিচ্ছিন্নতা থাকে। অতএব সতীন একান্ত নিকটাত্মীয় হলে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন হয়, যা হারাম। তাছাড়া নিকটাত্মীয় সতীনের কথায় গায়ে ঝালা ধরে বেশী, দ্বন্দ্ব বাড়ে অধিক। কথায় বলে ‘আনসতীনে নাড়ে চাড়ে, বোন সতীনে পুড়িয়ে মারে।’ তাই ইসলাম এমন একান্ত নিকটাত্মীয়দেরকে একত্রে স্ত্রীরূপে জমা করতে নিষেধ করেছে। সুতরাং স্ত্রী থাকতে তার (সহোদরা, বৈপিত্রেয়ী, বৈমাত্রেয়ী বা দুধ) বোন (অর্থাৎ, শালী) কে বিবাহ করা হারাম। তদনুরূপ স্ত্রীর বর্তমানে তার খালা বা বোনঝি, ফুফু বা ভাইঝিকে বিবাহ করা অবৈধ। স্ত্রী মারা গেলে বা তালাক দিলে ইদ্দতের পর তার ঐ নিকটাত্মীয়র কাউকে বিবাহ করতে বাধা নেই। স্ত্রীর কাঠবাপের (বা মায়ের স্বামীর) অন্য স্ত্রীর মেয়েকে বিবাহ করতে দোষ নেই।[34]
চতুর্থ কারণঃ ইহরাম
হজ্জ বা উমরায় ইহরাম বাঁধা অবস্থায় বিবাহ ও বিবাহের পয়গাম হারাম। এই অবস্থায় কারো বিবাহ হলেও তা বাতিল।[35] পঞ্চম কারণঃ চারের অধিক সংখ্যা
চার স্ত্রী বর্তমান থাকতে পঞ্চম বিবাহ হারাম।[36] চারের মধ্যে কেউ ইদ্দতে থাকলে তার ইদ্দত শেষ না হওয়া পর্যন্ত অন্য বিবাহ করা যাবে না। ষষ্ঠ কারণঃ তিন তালাক।
স্ত্রীকে তিন তালাক তিন পবিত্রতায় দিলে অথবা জীবনের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে তিনবার তালাক দিলে ঐ স্ত্রীকে পুনঃ বিবাহ করা বৈধ নয়। যদি একান্তই তাকে পুনরায় ফিরে পেতে চায়, তবে ঐ স্ত্রী দ্বিতীয় স্বামী ও তার যৌনস্বাদ গ্রহণের পর সে সেবচ্ছায় তালাক দিলে অথবা মারা গেলে তবে ইদ্দতের পর তাকে পুনর্বিবাহ করতে পারে। নচেৎ তার পূর্বে নয়।[37] স্ত্রীকে তিন তালাক দেওয়ার পর লজ্জিত হয়ে ভুল বুঝতে পেরে তাকে ফিরে পেতে ‘হালালা’ পন্থা অবলম্বন বৈধ নয়। অর্থাৎ, স্ত্রীকে হালাল করার জন্য পরিকল্পিতভাবে কোন বন্ধু বা চাচাতো-মামাতো ভায়ের সাথে বিবাহ দিয়ে এক রাত্রি বাস করে তালাক দিলে পরে ইদ্দতের পর নিজে বিবাহ করা এক প্রকার ধোঁকা এবং ব্যভিচার। যাতে দ্বিতীয় স্বামী এক রাত্রি ব্যভিচার করে এবং প্রথম স্বামী ঐ স্ত্রীকে হালাল মনে করে ফিরে নিয়েও তার সাথে চিরদিন ব্যভিচার করতে থাকে। কারণ, প্রকৃতপক্ষে স্ত্রী ঐভাবে তার জন্য হালাল হয় না। যে ব্যক্তি হালাল করার জন্য ঐরূপ বিবাহ করে, হাদীসের ভাষায় সে হল ‘ধার করা ষাঁড়।’[38] এই ব্যক্তি এবং যার জন্য হালাল করা হয় সে ব্যক্তি (অর্থাৎ প্রথম স্বামী) আল্লাহ ও তদীয় রসূলের অভিশপ্ত।[39] জায়বদলী বা বিনিময়-বিবাহ বিনা পৃথক মোহরে বৈধ নয়। এ ওর বোন বা বেটিকে এবং ও এর বোন বা বেটীকে বিনিময় ক’রে পাত্রীর বদলে পাত্রীকে মোহর বানিয়ে বিবাহ ইসলামে হারাম।[40] অবশ্য বহু উলামার নিকট উভয় পাত্রীর পৃথক মোহর হলেও জায়বদলী বিয়ে বৈধ নয়। (যদি তাতে কোন ধোকা-ধাপ্পা দিয়ে নামকে-ওয়াস্তে মোহর বাঁধা হয় তাহলে।[41] মুত্আহ বা সাময়িক বিবাহও ইসলামে বৈধ নয়। কিছুর বিনিময়ে কেবল এক সপ্তাহ বা মাস বা বছর স্ত্রীসঙ্গ গ্রহণ করে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় যেহেতু ঐ স্ত্রী ও তার সন্তানের দুর্দিন আসে, তাই ইসলাম এমন বিবাহকে হারাম ঘোষণা করেছে।[42] অনুরূপ তালাকের নিয়তে বিবাহ এক প্রকার ধোঁকা। বিদেশে গিয়ে বা দেশেই বিবাহ-বন্ধনের সময় মনে মনে এই নিয়ত রাখা যে, কিছুদিন সুখ লুটে তালাক দিয়ে দেশে ফিরব বা চম্পট দেব, তবে এমন বিবাহও বৈধ নয়। (এরূপ করলে ব্যভিচার করা হয়।) কারণ, এতেও ঐ স্ত্রী ও তার সন্তানের অসহায় অবস্থা নেমে আসে।[43] যাতে নারীর মান ও অধিকার খর্ব হয়। কোন তরুণীর বিনা সম্মতিতে জোরপূর্বক বিবাহ দেওয়া হারাম। এমন বিবাহ-বন্ধন শুদ্ধই হয় না।[44]
বাল্য-বিবাহ বৈধ।[45] তবে সাবালক হওয়ার পর স্বামী-স্ত্রীর এক অপরকে পছন্দ না হলে তারা বিবাহবন্ধন ছিন্ন করতে পারে।[46] সববংশ বা সবগোত্রের আত্মীয় গম্য পাত্র-পাত্রীর বিবাহ বৈধ। তবে ভিন্ন গোত্রে অনাত্মীয়দের সাথেই বৈবাহিক-সূত্র স্থাপন করা উত্তম।[47] বিশেষ করে সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি ও মনোমালিন্য নিয়ে বাড়াবাড়ি অধিক হয় সবগোত্রে ঘরে-ঘরে বিবাহ হলে। অভিজ্ঞরা বলেন, ‘ঘরে-ঘরে বিয়ে দিলে, ঘর পর হয়ে যায়। আত্মীয়তা বাড়াতে গিয়ে তা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় একেবারেই।’ অবশ্য সর্বক্ষেত্রে দ্বীনদারীই হল কষ্টিপাথর। কোন মুসলিম কোন ব্যভিচারিণী নারীকে বিবাহ করতে পারে না। বরং এ ব্যাপারে ঐরূপ নারী মনোমুগ্ধকর সুন্দরী রূপের ডালি বা ডানা-কাটা পরি হলেও মুসলিম পুরুষের তাতে রুচি হওয়াই উচিৎ নয়। একান্ত প্রেমের নেশায় নেশাগ্রস্ত হলেও তাকে সহধর্মিনী করা হারাম। এ ব্যাপারে আল্লাহ পাক বলেন, ﴿الزَّانِي لاَ يَنْكِحُ إِلاَّ زَانِيَةً أَوْ مُشْرِكَةً وَالزَّانِيَةُ لا يَنْكِحُهَا إِلاَّ زَانٍ أَوْ مُشْرِكٌ وَحُرِّمَ ذَلِكَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ﴾ ‘‘ব্যভিচারী কেবল ব্যভিচারিণী অথবা অংশীবাদিনীকে এবং ব্যভিচারিণী কেবল ব্যভিচারী অথবা অংশীবাদী পুরুষকে বিবাহ করে থাকে। আর মুমিন পুরুষদের জন্য তা হারাম করা হল।’’[48] সুতরাং অসতী নারী মুশরিকের উপযুক্ত; মুসলিমের নয়। কারণ উভয়েই অংশীবাদী; এ পতির প্রেমে উপপতিকে অংশীস্থাপন করে এবং ও করে একক মা’বূদের ইবাদতে অন্য বাতিল মা’বূদকে শরীক। (অবশ্য অসতী হলেও কোন মুশরিকের সাথে কোন মুসলিম নারীর বিবাহ বৈধ নয়।) পক্ষান্তরে ব্যভিচারিণী যদি তওবা করে প্রকৃত মুসলিম নারী হয়, তাহলে এক মাসিক অপেক্ষার পর তবেই তাকে বিবাহ করা বৈধ হতে পারে। গর্ভ হলে গর্ভাবস্থায় বিবাহ-বন্ধন শুদ্ধ নয়। প্রসবের পরই বিবাহ হতে হবে।[49] ফুটনোটঃ[1] (সূরা আন-নিসা (৪) : ২৩)
[2] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ৯/৭৩)
[3] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ৩/৩৭০, ৪/৩৩২)
[4] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ২/২৬২, ৯/৬৭)
[5] (সিলসিলা যয়ীফাহ ১/৫৬৬, ইখতিয়ারাত ইবনে তাইমিয়্যাহ ৫৮৫-৫৮৮পৃঃ, ফাতাওয়া মুহাম্মদ বিন ইব্রাহীম ১০/১৩০)
[6] (মুমঃ ৭/৪৪)
[7] (ঐ ৭/৪৫)
[8] (সূরা আল-বাক্বারা (২) : ২৩৩)
[9] (মুসলিম)
[10] (আহকামু খিতবাতিন নিকাহি ফিল ইসলাম, ডক্টর শওকত উলাইয়্যান)
[11] (বুখারী ৫০৯৯নং, মুসলিম)
[12] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ৬/২৬৩)
[13] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ৬/২৬৬)
[14] (সূরা আন-নূর (২৪) : ৬-৯, বুখারী, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩৩০৭নং)
[15] (আহকামু খিতবাতিন নিকাহি ফিল ইসলাম ১১৬পৃঃ)
[16] (সূরা আল-বাক্বারা (২) : ২২১)
[17] (সূরা আল-মুমতাহিনা (৬০) : ১০)
[18] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ১৬/১১৫,১৭/৬১, ২৮/৯৩)
[19] (সূরা আল-মায়িদা (৫) : ৫)
[20] (ইসলাম মেঁ হালাল অ হারাম, ইউসুফ ক্বারযাবী, অনুবাদ, শাম্স পীরযাদাহঃ ২৪৫পৃঃ)
[21] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ২৮/৯৩)
[22] (ফাতাওয়াল মারআহ ৪৬পৃঃ)
[23] (বুখারী ৫২৮৬নং, ফাতাওয়া নাযীরিয়্যাহ ২/৩৫৭)
[24] (সূরা আন-নিসা (৪) : ৩)
[25] (তামবীহাতুল মু’মিনাত ৬৭-৭৫পৃঃ দ্রঃ)
[26] (সূরা আন-নিসা (৪) : ৩)
[27] (সূরা আন-নিসা (৪) : ১২৯)
[28] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ২৫/৬৭)
[29] (সূরা আন-নিসা (৪) : ২৮)
[30] (সূরা আল-বাক্বারা (২) : ২৩৫)
[31] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ৯/৫৪,৭২)
[32] (মানারুস সাবীল ২/৮৮পৃঃ)
[33] (ফাতাওয়া ইবনে উসাইমীন ২/৭৬৬)
[34] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ৯/৫৭)
[35] (যাদুল মাআদ ৪/৬)
[36] (সূরা আল-বাক্বারা (৪) :৩)
[37] (সূরা আল-বাক্বারা (২) : ২৩০)
[38] (ইরওয়াউল গালীল ৬/৩০৯)
[39] (ইরওয়াউল গালীল ১৮৯৭ নং, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩২৯৬)
[40] (বুখারী, মুসলিম ইত্যাদি)
[41] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ৪/৩২৮, ৯/৬৮)
[42] (বুখারী, মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩১৪৭নং)
[43] (ফাতাওয়াল মারআহ ৪৯পৃঃ)
[44] (ফাতাওয়াল মারআহ ৪৮ পৃঃ)
[45] (মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩১২৯নং)
[46] (বুখারী ৫১৩৮নং, আবু দাঊদ, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩১৩৬নং)
[47] (ফাতাওয়াল মারআহ ৪৭পৃঃ)
[48] (সূরা আন-নূর (২৪) : ৩)
[49] (ফাতাওয়া ইবনে উসাইমীন ২/৭৮০)
১০. পাত্রী পছন্দ:
পত্নী পুরুষের সহধর্মিনী, অর্ধাঙ্গিনী, সন্তানদাত্রী, জীবন-সঙ্গিনী, গৃহের গৃহিণী, সন্তানের জননী, হৃদয়ের শান্তিদায়িনী, রহস্য রক্ষাকারিণী, তার সুখী সংসারের প্রধান সদস্যা। সুতরাং এমন সাথী নির্বাচনে পুরুষকে সত্যই ভাবতে হয়, বুঝতে হয়। শুধুমাত্র প্রেম, উচ্ছৃঙ্খলতা ও আবেগে নয়; বরং বিবেক ও দিমাগে সে বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে হয়। সাধারণতঃ মানুষ তার ভাবী-সঙ্গিনীর প্রভাব-প্রতিপত্তি, মান-যশ-খ্যাতি, ধন-সম্পদ, কুলীন বংশ, মনোলোভা রূপ-সৌন্দর্য প্রভৃতি দেখে মুগ্ধ হয়ে তার জীবন-সঙ্গ লাভ করতে চায়; অথচ তার আধ্যাত্মিক ও গুণের দিকটা গৌণ মনে করে। যার ফলে দাম্পত্যের চাকা অনেক সময় অচল হয়ে রয়ে যায় অথবা সংসার হয়ে উঠে তিক্তময়। কিন্তু জ্ঞানী পুরুষ অবশ্যই খেয়াল রাখে যে, ‘‘দেখিতে পলাশ ফুল অতি মনোহর, গন্ধ বিনে তারে সবে করে অনাদর। যে ফুলের সৌরভ নাই, কিসের সে ফুল? কদাচ তাহার প্রেমে মজেনা বুলবুল। গুণীর গুণ চিরকাল বিরাজিত রয়, তুচ্ছ রূপ দুই দিনে ধূলিসাৎ হয়।’’ প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, تُنْكَحُ الْمَرْأَةُ لِأَرْبَعٍ لِمَالِهَا وَلِحَسَبِهَا وَجَمَالِهَا وَلِدِينِهَا فَاظْفَرْ بِذَاتِ الدِّينِ تَرِبَتْ يَدَاكَ. ‘‘রমণীকে তার অর্থ, আভিজাত্য, রূপ-সৌন্দর্য ও দ্বীন-ধর্ম দেখে বিবাহ করা হয়। কিন্তু তুমি দ্বীনদারকে পেয়ে কৃতকার্য হও। তোমার হস্ত ধূলিধূসরিত হোক।’’[1] তিনি আরো বলেন, ليَتَّخذَ أحَدُكُمْ قَلْباً شَاكِراً وَلِسَاناً ذَاكراً وَزَوْجَةً صَالِحَةً تُعينُهُ عَلَى أَمرِ الآخِرَة. ‘‘তোমাদের প্রত্যেকের শুক্রকারী অন্তর ও যিক্রকারী জিহ্বা হওয়া উচিৎ। আর এমন মুমিন স্ত্রী গ্রহণ করা উচিৎ; যে তার আখেরাতের কাজে সহায়তা করবে।’’[2] সুতরাং এমন পাত্রী পছন্দ করা উচিৎ, যে হবে পুণ্যময়ী, সুশীলা, সচ্চরিত্রা, দ্বীনদার, পর্দানশীন; যাকে দেখলে মন খুশীতে ভরে ওঠে, যাকে আদেশ করলে সত্বর পালন করে, স্বামী বাইরে গেলে নিজের দেহ, সৌন্দর্য ও ইজ্জতের এবং স্বামীর ধন-সম্পদের যথার্থ রক্ষণা-বেক্ষণা করে।[3] মহান আল্লাহ বলেন, ﴿فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللهُ﴾ ‘‘সুতরাং সাধবী নারী তো তারা, যারা (তাদের স্বামীদের অনুপস্থিতিতে ও লোক চক্ষুর অন্তরালে) অনুগতা এবং নিজেদের ইজ্জত রক্ষাকারিণী; আল্লাহর হিফাযতে (তওফীকে) তারা তা হিফাযত করে।’’[4] এরপর দেখা উচিৎ, ভাবী-সঙ্গিনীর পরিবেশ। শান্ত প্রকৃতির মেজাজ, মানসিক সুস্থতা ইত্যাদি; যাতে সংসার হয় প্রশান্তিময়। জবালাময়তা থেকে দূর হয় বাক্যালাপ, লেন-দেন ও সকল ব্যবহার। বিবাহের একটি মহান উদ্দেশ্য হল সন্তান গ্রহণ । এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে স্ত্রী নির্বাচন বাঞ্ছনীয়। প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, تَزَوَّجُوا الْوَدُودَ الْوَلُودَ فَإِنِّي مُكَاثِرٌ بِكُمْ الْأُمَمَ. ‘‘অধিক প্রেমময়ী, অধিক সন্তানদাত্রী রমণী বিবাহ কর। কারণ, আমি তোমাদেরকে নিয়ে কিয়ামতে অন্যান্য উম্মতের সামনে (সংখ্যাধিক্যের ফলে) গর্ব করব।’’[5] অতঃপর সাথীর রূপ-সৌন্দর্য তো মানুষের প্রকৃতিগত বাঞ্ছিত বাসনা। যেহেতু স্ত্রী সুন্দরী হলে মনের প্রশান্তি ও আনন্দ অধিক হয়। অন্যান্য রমণীর প্রতি কখনই মন ছুটে না। পরন্তু ‘‘আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন।’’[6] অনেক যুবক আছে যারা ভুল করে মহিলার চেহারাকে বিবাহ করে, কিন্তু সংসার করে তার সবকিছু নিয়ে! ফলে অশান্তি দেখা দেয় সংসারে। অতঃপর দেখার বিষয় সঙ্গিনীর কৌমার্য। কুমারীর নিকট যে সুখ আছে অকুমারীর নিকট তা নেই। এটা তো মানুষের প্রকৃতিগত পছন্দ। যেহেতু ভালোবাসার প্রথম উপহার তার নিকট পেলে দাম্পত্যে পূর্ণ পরিতৃপ্তি আসে। নচেৎ যদি তার মনে ভালোবাসার নিক্তি পূর্ব ও বর্তমান স্বামীর প্রেম ওজন করতে শুরু করে, তবে সেই তুলনায় তার হৃদয় কখনো পূর্ব স্বামীর দিকে ঝুঁকে বর্তমান স্বামীকে তুচ্ছজ্ঞান করে। আবার কখনো নিজের ভাগ্যের এই পরিবর্তনকে বড় দুর্ভাগ্য মনে ক’রে ভালোবাসার ডালি খালি ক’রে রসহীন সংসার করে বর্তমান স্বামীর দেহপাশে। কিন্তু মন থাকে সেই মৃত অথবা সেই তালাকদাতা স্বামীর নিকট। ফলে দাম্পত্য জীবন মধুর হয়ে গড়ে উঠতে পারে না। অবশ্য বর্তমান স্বামী পূর্ব স্বামী হতে সর্ববিষয়ে উত্তম হলে সে কথা ভিন্ন। পরন্তু প্রকৃত দাম্পত্য-সুখ উপভোগ করার উদ্দেশ্যে প্রিয় নবী (সাঃ) এক সাহাবীকে কুমারী নারী বিবাহ করতে উদ্বুদ্ধ করে বলেছিলেন, أَفَلاَ تَزَوَّجْتَ بِكْرًا تُلاَعِبُكَ وَتُلاَعِبُهَا. ‘‘কেন কুমারী বিবাহ করলে না? সে তোমাকে নিয়ে এবং তুমি তাকে নিয়ে প্রেমকেলি করতে।’’[7] অন্যত্র তিনি বলেন, عَلَيْكُمْ بِالأَبْكَارِ فَإِنَّهُنَّ أَعْذَبُ أَفْوَاهًا وَأَنْتَقُ أَرْحَامًا (وأسخًنُ أقبالاً، وأقَلُّ خباً) وَأَرْضَى بِالْيَسِيرِ. ‘‘তোমরা কুমারী বিবাহ কর। কারণ কুমারীদের মুখ অধিক মিষ্টি, তাদের গর্ভাশয় অধিক সন্তানধারী, তাদের যোনীপথ অধিক উষ্ণ, তারা ছলনায় কম হয় এবং সবল্পে অধিক সন্তুষ্ট থাকে।’’[8] উর্বর জমিতে যে ফসলের বীজ সর্বপ্রথম রোপিত হয় সেই ফসলই ফলনে অধিক ও উত্তম হয়। ফসল তুলে সেই জমিতেই অন্য ফসল রোপন করলে আর সেই সোনার ফসল ফলে না। অনুরূপ ভালোবাসার বীজও। অবশ্য যার সংসারে পাক্কা গৃহিণীর প্রয়োজন, যে তার ছোট ছোট ভাই-বোন ইত্যাদির সঠিক প্রতিপালন চায়, তাকে অকুমারী বিধবা বিবাহ করাই উচিৎ।[9] পরন্তু যদি কেউ কোন বিধবা বা পরিত্যক্তার প্রতি এবং তার সন্তান-সন্ততির প্রতি সদয় হয়ে তাকে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ ক’রে তার দুর্দিন দূর ক’রে সুদিন আনে, তবে নিশ্চয় সে ব্যক্তি অধিক সওয়াবের অধিকারী।[10] সর্বদিক দিয়ে নিজের মান যেমন, ঠিক সেই সমপর্যায় মান ও পরিবেশের পাত্রী পছন্দ করা উচিৎ। এতে কেউ কারোর উপর গর্ব প্রকাশ না করতে পেরে কথার আঘাতে প্রেমের গতি বাধাপ্রাপ্ত হবে না। পজিশন, শিক্ষা, সভ্যতা, অর্থনৈতিক অবস্থা, বংশ প্রভৃতি উভয়ের সমান হলে সেটাই উত্তম। যেমন উভয়ের বয়সের মধ্যে বেশী তারতম্য থাকা উচিৎ নয়। নচেৎ ভবিষ্যতে বিভিন্ন জোয়ার-ভাটা দেখা দিতে পারে। উপর্যুক্ত সর্বপ্রকার গুণ ও পজিশনের পাত্রী পেলেই সোনায় সোহাগা। এমন দাম্পত্য হবে চিরসুখের এবং এমন স্বামী হবে বড় সৌভাগ্যবান। পক্ষান্তরে কিছু না পেলেও যদি দ্বীন পায়, তবে তাও তার সৌভাগ্যের কারণ অবশ্যই। সুতরাং বউ ও জামাই পছন্দের কষ্টিপাথর একমাত্র দ্বীন ও চরিত্র। বংশের উচ্চ-নীচতা কিছু নেই। যেহেতু মানুষ সকলেই সমান। সকল মুসলিম ভাই-ভাই। মহান আল্লাহ বলেন, ﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوباً وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ﴾ ‘‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী হতে সৃষ্টি করেছি। পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে; যাতে তোমরা এক অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে ব্যক্তি অধিক সংযমী (মুত্তাকী ও পরহেযগার)।’’[11] তাছাড়া ‘ভালো-মন্দ কোন গোষ্ঠী-বর্ণের মধ্যে নির্দিষ্ট নয়। প্রত্যেক বস্ত্তর উত্তম, মধ্যম ও অধম আছে।’ আর ‘কাকের ডিম সাদা হয়, পন্ডিতের ছেলে গাধাও হয়।’ সুতরাং বিবেচ্য হল, যে মানুষকে নিয়ে আমার দরকার কেবল তারই চরিত্র ও ব্যবহার। অবশ্য পারিপাশির্বক অবস্থা দেখাও দরকার নিশ্চয়ই। কারণ, তাতেও কুপ্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকতে পারে।